সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি

সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি

শহুরে সন্ধ্যার অনেকগুলো নিজস্ব আলো আছে। লালাভ, উজ্জ্বল ছাইবর্ণ, সবুজ। প্রায় অভ্যেসে পরিণত হয়ে যাওয়া নিত্য জীবনে সেই আলোর দিকে আলাদা করে তাকাবার অবসর মেলে কই? আজ তাই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে কাঁপতে থাকা নগরী যখন দিবস শেষের ক্ষীণ আলোটুকুতে ঝিমোচ্ছে, আকাশের দিকে চেয়ে মনে হলো, বেশ, এমন গাঢ় নীল কি হয় কোনো কোনো সন্ধ্যা?

প্লাস্টারবিহীন ছ’তলা-চারতলা দালানগুলোর শরীরে ঝরে পড়ছে নীলের গুঁড়ো, একটু একটু করে আঁধার হচ্ছে চারধার। নীল থেকে কালো হবে পৃথিবী। মিরপুর সি ব্লকের বাস্তুহারা গলিটা দিয়ে আমি মুসলিম বাজারের দিকে যাচ্ছি। আম্মার জন্য পান কিনব। দেখলাম ঘোলাটে নীলাভ আলোয় ঘাড় কাত করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটা কুকুর। ঘিয়ে হবে গায়ের রঙ। ও কাছাকাছি আসতে আমি থেমে গেলাম। লুঙ্গিতে নাক ঠেকিয়ে কিছু শুঁকতে চেষ্টা করল কুকুরটা। তারপর যেখান থেকে এসেছিল সেই পুরনো আমলের মিরপুরীয় একতলা টিনশেড ঘরটার দিকে চারপায়ে তেরছা ভঙ্গিতে ফিরে গেল, লোহার বন্ধ দরজার সামনে থাবা গেড়ে বসে ধুঁকতে লাগল জিভ বের করে।

পান কিনতে কিনতে মনে হলো, শৈশবে এমন সামান্য একটা ঘটনারও ক্ষমতা ছিল আমার কয়েক রাতের ঘুম শুষে নেবার। কুকুরভীতি ছিল আমার, কুকুর কামড়ে দিলেই নিশ্চয়ই জলাতঙ্ক হবে। যে প্রাণঘাতী অসুখে আস্ত একটা মানুষ কুকুরে রূপান্তরিত হয়। পানির তৃষ্ণায় চিৎকার করে, কেউ পানি এগিয়ে দিলেই ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে আর আশপাশে যাকেই পায় আক্রমণ করে। গ্রামসূত্রে আমার এক চাচার বউ অমন অসুখে মারা গিয়েছিলেন। কোন এক বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কুকুরের কামড় খেয়েছিলেন সেই চাচী, কেউই গুরুত্ব দেয়নি। অনেকে ধারণা করেছিল, কামড়ের মাস দুয়েক পরেই জলাতঙ্ক থাবা গেড়ে বসেছিল তার শরীরে। মৃত্যুর বহুদিন পরেও যাকে নিয়ে আলাপ করত সবাই। গ্রামে নতুন করে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল নিরীহ গোবেচারা কুকুরের দল।

মুসলিম বাজার থেকে ঘরে ফিরেও কুকুর ও জলাতঙ্ক বিষয়ক ভাবনা মন থেকে সরল না। বরং মনে হলো, সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি এখনো সতেজ আছে আমার হৃদয়ে। দিন কয়েক আগেই পড়ে শেষ করেছি মার্কেসের উপন্যাস প্রেম ও অন্যান্য দানব।* 

মানুষের পৃথিবীতে কে আসল দানব? ছোট্ট বইটায় এ প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল শব্দের পর শব্দে। উপন্যাসটির শুরু হয় র‍্যাবিজ আক্রান্ত এক কুকুরের কামড় থেকে। অমন গল্পে ঘোর তৈরি না হবার কোনো কারণ আসলে নেই।

পড়তে পড়তেই দেখতে পাওয়া যায় আঠারশো শতকের সেই সমুদ্রলাগোয়া জনবহুল বন্দর শহরটি। দাস বেচাকেনা হচ্ছে। বহু আকাঙ্ক্ষিত দাসবাহী এক জাহাজের অনেকেই মারা গিয়েছে অজ্ঞাত কারণে, সেসব মৃত নিগ্রো আর তাদের প্রভুদের ফুলে ওঠা দেহ ও দূষিত রক্তে লাল হয়ে উঠেছে সমুদ্রের জল। ওসবের মাঝখানেই নিজের দ্বাদশতম জন্মদিন উপলক্ষে কেনাকাটা করতে আসা সিয়েরভা মারিয়াকে দেখতে পেলাম, উন্মত্ত একটা কুকুর আরো তিনজন মানুষসহ তাকেও কামড় দিল। বাজার ভর্তি লোকজন দেখল ক্ষীয়মান তবু ক্ষমতাশীল এক জমিদারের কন্যা সিয়েরভা মারিয়ার এই দুর্ঘটনা। র‍্যাবিজ আক্রান্ত কুকুরের কামড়ে বাকি তিনজন একে একে মারা গেলেও সিয়েরভা মারিয়ার কিছু হলো না, কোনো অসুখের চিহ্নই দেখা দিল না তার মধ্যে। মধ্যযুগের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো শহরবাসী, প্রবল প্রতাপশালী চার্চ, যে দুজন নর-নারীর ঘৃণাজর্জর সঙ্গমে মেয়েটির জন্ম, তারা সবাই কি এই অস্বাভাবিক সুস্থতা মেনে নিতে পারবে?

২.
লেখকের অন্যান্য বইয়ের মতোই কাহিনীটা বলা হচ্ছে উঁচু থেকে। নইলে একটা গ্রামোফোন রেকর্ডে বেজে চলেছে দূরবর্তী এক রহস্যময় পুরুষকণ্ঠ। যিনি পড়ে যাচ্ছেন এমন এক কিশোরীর শোকগাথা, যার লালচে ঝাঁকড়া চুল জন্মের পর আর কাটা হয়নি। বড় হতে হতে যে বিস্ময়কর চুলের রাশি মাটি ছুঁয়েছে, যার মা জন্মের পর থেকেই তাকে ঘৃণা করেছে, মেয়েটা বড় হয়েছে কৃতদাসদের তত্ত্বাবধানে, তাদের সঙ্গেই। সমাজের চোখে মানুষ বা মানুষের চোখে সমাজ, দুটোই দুটির কাছে যে বন্দী, তার নিদারুণ জলরঙ আঁকতে চেষ্টা করে এই উপন্যাস।

সময়টা আঠারশো শতক, এ তো আগেই বলেছি। সিয়েরভা মারিয়ার বাবা একজন মার্কিস বা জমিদার। যদি সমাজের শীর্ষস্থানীয় একজন লোকের মেয়ে জলাতঙ্কে মারা যায়, গোটা শহরের কাছে পরিবারটি অপমানিত হবে ও ছোট হয়ে যাবে, এই তাদের ধারণা। সম্মান ধরে রাখতে অনেক কিছুই করতে হয় মার্কিসকে, অথচ এমন নয় যে কিছু না করে থাকাটা অসম্ভব ছিল তার পক্ষে।

প্রথমত, মার্কিস চিকিৎসকের কাছে যান গোপনে। জানতে পারেন কুকুরে কামড়াবার কয়েকদিনের মধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে ভিকটিমেরা। একে একে মারাও গিয়েছে সবাই। এমনও হতে পারে সিয়েরভা মারিয়ার হবেই না জলাতঙ্ক। চিকিৎসক আব্রেনুনসিওর কথাতে ভরসা মেলে না তার। ধীরে ধীরে মার্কিসের সুস্থ মেয়েটিকে প্রায় অসুস্থ করে তুলতে চায় স্থানীয় চিকিৎসক ও কবিরাজের দল। কেন এই মেয়েটি অসুস্থ হচ্ছে না? কুকুরের কামড়াবার পর অবশ্যই জলাতঙ্ক হবার দরকার ছিল তার, যেহেতু তা হয়নি, শহরের মানুষেরা বিশ্বাস করতে শুরু করে দীর্ঘ চুলের রহস্যময় কিশোরিটি স্বাভাবিক কেউ না, নিশ্চয়ই সে একটা অশুভ শক্তি বা অশুভ কোনো কিছুই তার ওপরে ভর করেছে। এমন অবস্থাতেই কাহিনীতে প্রবল বিক্রমে প্রবেশ করে চার্চ। বিশপ। নান। কনভেন্ট।

৩.
লেখক হিসেবে মার্কেস তার চরিত্রগুলো কিভাবে নির্মাণ করেছেন?
এখানে স্বভাবতই লোকটা ব্যবহার করেছেন তার চিরচেনা কৌশল। চরিত্রগুলোকে অনবরত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের খণ্ডখণ্ড গল্প। উপন্যাসের একমাত্র প্রগতিশীল চরিত্র আব্রেনুনসিও। এই চিকিৎসক শহরটিতে কিংবদন্তি এবং চার্চ ও স্থানীয় অন্যান্য চিকিৎসকেরা তাকে শত্রু মনে করে। এর পেছনে কারণ হিসেবে আমরা জানতে পারি রোগী কখন মারা যাবে তার ঠিকঠিক ঘোষণা দেন আব্রেনুনসিও। তিনি এমন একটা ট্যাবলেট আবিষ্কার করেন যেটা খেলে সারা বছর সুস্থ থাকা যায়। কিন্তু সেবনের প্রথম কয়েকদিন রোগী হয়ে যাবে উন্মাদ। যে কারণে ওই বিদঘুটে ট্যাবলেট আব্রুনেনসিও নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই খাওয়াতে পারেন না।

সিয়েরভা মারিয়া যাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে এলো, সেই মার্কিস আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী বের্নাদা-র পটভূমি প্রায় নারকীয়। যার রেশ পুরো উপন্যাস জুড়েই চলতে থাকে, আমরা অনুমান করতে পারি কেন বের্নাদা নিজের জন্ম দেওয়া কন্যা সন্তানকে এত ঘৃণা করেন, আর মার্কিসই বা কেন নিজের মেয়েকে স্বাভাবিক ভালোবাসাটুকু দিতে না পারার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হন।

পিতা-মাতার ঘৃণ্য দাম্পত্য জীবনের পাশাপাশি আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় চার্চের গ্রন্থাগারিক কায়েতানো দেলাউরার সঙ্গে সিয়ের্ভা মারিয়ার প্রেম। চার্চ মনে করে কনভেন্টে বন্দী মারিয়ার ওপর ভর করেছে এক দানব, আর সেই দানব তাড়ুয়া হিসেবে নিয়োগ পায় দেলাউরা। চরিত্র হিসেবে দেলাউরা নিজের অর্জিত বিবেক আর নিয়তির সঙ্গে অনবরত সংগ্রামরত এক যুবক। সম্ভবত চিকিৎসক আব্রেনুনসিওর পর এ উপন্যাসে সে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। ছত্রিশ বছর বয়সী এ যুবক একই সঙ্গে যুক্তিবাদী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। দুটি বিষয়ের একটা চিরন্তন দ্বন্দ্বে প্রতি মুহূর্তে বিধ্বস্ত হতে থাকে সে। ধর্মে বিশ্বাসী যে হৃদয় নিয়ে সে ভাবে প্রেম হলো আদিমতম পাপ, আবার প্রেমের সুতীব্র তাড়না তাকে করে তুলতে চায় বিদ্রোহী, হয়তো করেও তোলে শেষের দিকে?

আর সিয়েরভা মারিয়া? সে বুনো একটা ঝড়ের মতো। মিথ্যে বলার ওস্তাদ। সৌন্দর্যে অলৌকিক। ক্রীতদাসদের সঙ্গে বড় হয়ে উঠবার কারণে যে কোনো স্বাভাবিক আদপ-কেতা জানে না, বড়দের শত্রু মনে করে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়েও মেয়েটা ভালোবাসার কাঙাল। তাকে মনে হয় প্রকৃতির একটা বন্য শক্তি, প্রাণের উৎস। বয়স যাকে বড় করে তোলে প্রতিদিন, আর সৌন্দর্য করে তোলে রহস্যময়। যে রহস্য তার আশপাশের কেউই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না।

৪.
প্রেমের গল্পের আবরণে হয়তো মার্কেস কুসংস্কারের কুড়ালে ছিন্নমস্তক সব হতাভাগ্য মানুষের গল্পই করতে চেয়েছেন ছোট আকারের এই আখ্যানে। নর-নারীর প্রেম, গুরু-শিষ্যের প্রেম, জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানীর প্রেম।

প্রত্যেকটি প্রেমের গল্পেই আমাদের এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, প্রেমই কি সেই দানব যা মানব জীবনকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়? নাকি আসল দানবেরা লুকিয়ে আছে মানুষের মাঝেই, যারা প্রেমের মতো স্বর্গীয় ব্যাপারটিকে চিরকাল অপবিত্র করতে চেয়েছে, ধ্বংসের পক্ষ নিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে?

পুরাতন শিষ্য কায়েতানোকে কুষ্ঠরোগীদের হাসপাতালে পাঠান বিশপ, প্রেম হেরে যায়। চার্চের আদেশে প্রিয় কন্যাকে কনভেন্টে পাঠান মার্কিস, প্রেম হেরে যায়। কিন্তু দেলাউরা আর সিয়ের্ভা মারিয়া? তাদের প্রেমের পরিণতি চিরন্তন। সেখানে কল্পনার কোনো আশ্রয় নিতে হয় না।

৫.
সবশেষে তাহলে কী অবশিষ্ট থাকে? নিখাদ গল্পই। চার্চ তার পূর্বেকার ক্ষমতা হারায়। প্রাচীন সেই কনভেন্ট পরিণত হয় হাসপাতালে, তারপর যা ভেঙে তৈরি হবে সুপার মার্কেট।

এক তরুণ সাংবাদিক কনভেন্টের নিচে ঘুমিয়ে থাকা অজস্র কঙ্কালের মাঝে আবিষ্কার করেন সিয়েরভা মারিয়াকে, যাকে সময় পুরোপুরি গিলে নিতে পারেনি, রয়ে গেছে তার আগুনরঙা ও শতাব্দীর দীর্ঘতম চুলের বহর। কবর খুঁড়তে থাকা আবেগহীন শ্রমিকদের ফোরম্যান সাংবাদিকটিকে জানান, ‘সে কি আপনি জানেন না? মৃত্যুর পর প্রতি মাসেই তো মানুষের চুল এক সেন্টিমিটার করে বাড়ে?’

যা নেই তাকে ফিরিয়ে আনতে মানুষ অনন্ত সংগ্রাম করে। আর যা আছে, তাকে বিলুপ্ত করতেও মানুষের প্রচেষ্টা তুলনাহীন। কথাগুলো অনবরত মাথার ভেতরে শাফল হয় আর সুদূর দ্বীপের হতভাগ্য রাজকন্যা সিয়েরভা মারিয়ার জন্য আমার মন কেমন করে।

রচনাকাল: সেপ্টেম্বর ২০১৯


*(১৯৯৪ সালে এসপানিওল থেকে Edith Grossman কৃত ইংরেজি অনুবাদ হওয়া বই, বাংলা অনুবাদক আলী আহমদ)।

**লেখাটি এর আগে বার্তা২৪ ডটকমে পূর্বপ্রকাশিত

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন