স্মৃতির দুর্ভিক্ষ

ভিডিও ক্লাবের দিনগুলো ঝাপসা ছবির মত একেক বিকেলে মগজের পর্দায় দুলে ওঠে।

নব্বইয়ের দশক। বইয়ের মত শেলফে সাজানো থরে থরে ভিসিআরের ক্যাসেট। সিনেমা পাগল তরুণদের মাঝে তৈরি হওয়া একটা কমিউনিটি। ভাগাভাগি করে নতুন ভিডিও ক্যাসেট এ ঘর ও ঘর করত। সন্ধ্যা বা দুপুরের অবসরে ডেস্কে দাঁড়িয়ে আড্ডা। বাইরে বিখ্যাত কোন সিনেমার পোস্টার, লাস্ট অব দা মোহিকানসের ডে লুইস অথবা প্রিডেটরের জঙ্গলে অস্ত্রহাতে শোয়ার্জনেগার নইলে মাইকেল ডগলাসের কাঁধে শরীর আড়াল করে তাকিয়ে থাকা শ্যারন স্টোন (নামগুলো আরও পরে জেনেছি)?

এসব দৃশ্য ঝাপসাই, কেননা তখন ভিডিও ক্লাব আমার নাগালের বাইরে। দোকানগুলো দেখলেই কেমন এক রহস্যময় আবেশ খেলা করত ভিতরে, এখনও তা টের পাওয়া চলে।

এরপর একদিন ভিডিও ক্লাবগুলোর দিন ফুরিয়ে গেল, বাসায় জমে থাকা অনেক ক্যাসেট ফেরত দেয়া হলনা, কোন কোন ক্লাব উঠেই গেল। কেউবা বদলে নিল সিডি ডিভিডির নতুনত্বের সঙ্গে। কমিউনিটি তখনও পুরোপুরি নষ্ট হয়নাই। বালকযুগ আর কৈশোরে সিডি প্লেয়ার বা চাকতি মত বাক্সবন্দি জিনিসটাকে দারুণ মনে হত। কে জানত, ঐ চাকা হতে যাচ্ছে সশরীরে নগর ঘুরে বেড়ানো ভিডিও ক্লাবগুলোর শেষ অবলম্বন, একদিন ফেসবুকের সিনেমার গ্রুপগুলো তার যায়গা দখল করে নেবে? মানুষ কেবল সিনেমার লিংক শেয়ার করবে, ডাউনলোড করবে আর এক সময় ডাউনলোড করাও কমে আসবে, চালু হবে অনলাইন স্ট্রিমিং।

নতুন কোন সিনেমা এলো, আর পকেটে ক্যাসেট ভাড়ার টাকা নিয়ে পায়ে পায়ে ভিডিও ক্লাবের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ এখন বিলুপ্ত হয়েছে। গ্রামবাসের এডভেঞ্চার ছিল আরও এমেজিং। সন্ধ্যা থেকে রাতের প্রথম প্রহর, কয়েক কিলোমিটার পথ ভেঙ্গে দুরের কোন বাজারে পছন্দের সিনেমা সন্ধানে গিয়ে দেখা যেত, ওটা অন্য কেউ নিয়ে গেছে। ভিডিও ক্লাবের লোকটা বলছে, “নাম লিখায়ে যাউ ভাইডি, কাল সকাল সকাল আইসে নিয়ে যাইয়েনে।”

প্রযুক্তির সুবিধা নিতে মন্দ তো লাগেনা। বরং জীবনে কত গতি এনেছে এই শব্দ ও প্রয়োগ। তবু মনে হয়, টেকনোলজি যত আধুনিক হবে, দিনের পর দিন মানুষ হারাবে তার সবচেয়ে বড় অর্জন, স্মৃতি।

আমাদের রোজকার জীবনে ঘটনা কমে আসবে। দেখা যাবে, একমাসের ত্রিশটা দিন একই রকম যাচ্ছে, একটার সঙ্গে আরেকটাকে আলাদা করা যাচ্ছেনা। ঘটনাহীনতা মানেই তো এক অর্থে জমিয়ে রাখার মত স্মৃতির দুর্ভিক্ষ।
~

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন