আয়না ভ্রমণ

kenneth agnello

আমরা সবাই ব্যাপারটা মেনে নিলাম একবাক্যে। প্রথমে ঘাটে জড়ো হওয়া লোকজন। এরপরে নদী তীরে গরমে পুড়তে থাকা থাকা গাছপালা। ক্ষমাহীন উত্তপ্ত বাতাসের একটা ঝড়ও কয়েক মুহূর্তের জন্য হাজির হল আমাদের ঐক্যমত জানাতে – পৃথিবীতে আজকের মত দীর্ঘ দুপুর এর আগে কখনও আসেনি।

এমন এক দুপুরে আমরা দেখতে পেলাম আবু রায়হান হেঁটে আসছে। হয়ত নদী পার হয়ে শহরে যাওয়া দরকার। বাসা থেকে বেরিয়ে মাইল খানেক পথ হয়ত সে হেঁটেই এসেছে, ভ্যান মেলেনি দুপুরের জনশূন্যতায়। কাজটা জরুরি কিনা, বিকেল হবে রোদ পড়বে এতটা অপেক্ষা করার উপায় ছিল কিনা, কেই বা নিশ্চিত জানাবে আমাদের?   

বলতে বাহুল্য, দক্ষিণে এ বছরটায় মরুভূমির উত্তাপ নেমেছে। দিনের বেলা ঘরে-বাইরে যেখানেই থাকিনা কেন, আমাদের গায়ের রক্তগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে ঘাম হয়ে। যেমন আমরা গোপনে ভাবতাম, পুরুষের বীর্য মানেই বিন্দু বিন্দু রক্ত এবং সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া মায়ের দুধের প্রত্যেক ফোঁটাও বিন্দু বিন্দু রক্ত। হয়ত এমন ধারা গরমে কাহিল হয়েই খেয়াঘাটের কাছাকাছি এসে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় আবু রায়হান। চৌদ্দফিট চওড়া রাস্তাটি সম্প্রতি পিচঢালা হয়েছে। সেই রাস্তার মাঝখানে চিতিয়ে পড়লো সে।

চন্দনীমহল খেয়াঘাট কখনোই লোকারণ্য হয়ে থাকে না। তবে আমরা তো থাকিই অনেকে, আমাদের কেউ না কেউ থাকবেই। এসমস্ত দীর্ঘ দুপুরে একজন পুরুষ মানুষ যখন রাস্তায় উল্টে পড়ে যায়, দৃশ্যটি সহজেই আমাদের নজর কাড়ে। তাকে ঘিরে আমরা একটা ভিড় জমিয়ে দিলাম। ঘাটের ইজারাদারদের ঠিক করা দুজন লোক, ছাউনির নিচে বসে থাকা কয়েকজন যাত্রী, ঘাটে ভেড়া শেষ ট্রলারটি থেকে নেমে আসা মানুষেরা – আমরা এগিয়ে গেলাম সবাই মিলে। 

দীর্ঘাঙ্গ এক লোক মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছে। পতনের সময় কোন এক উপায়ে পিচঢালা রাস্তায় তার মাথাটা বাড়ি খেয়েছিল। কতটা জোরে বাড়ি খেয়েছে তা অনুমানের কী দরকার? মাথার নিচ থেকে মোটা রক্তধারা রাস্তা গড়িয়ে মাটিতে মিশেছে, সেই রক্তধারা জমা হচ্ছে একটি কচাগাছের গোড়ায়। আমরা চন্দনীমহলবাসীরা বিশ্বাস করি যে কচাগাছে কোনোদিন পানি দেবার দরকার হয় না। যত বেশি অবহেলা একটি কচাগাছ পাবে, সে ঠিক তত বিপুলাকায় হবে। অথচ এ মুহূর্তে আমরা দেখতে পেলাম কচাগাছটির গোড়ায় সরাসরি মানুষের রক্ত। এই কচাগাছের ভবিষ্যতের কোন কিনারা আমরা করতে পারিনা।

চন্দনীমহল খেয়াঘাটে সব সময় বহাল খবিরুল্লা গিয়েছিল পায়খানায়। ফিরে এসে বদনাটি ছাউনির নিচে পাতা এক বেঞ্চের তলায় রাখতে গিয়ে সে হয়ত আমাদের মতই দেখতে পেল ঘাটের অদূরে বিশাল ভিড় লেগেছে। কেননা আমরা শুনি যে গলা চড়িয়ে সে অনির্দিষ্ট কাউকে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে, “ওরে, হলোডা কী? কী হইছে রাস্তার মধ্যি?”

অবশ্য জবাবের অপেক্ষা না করে তাকে ভিড়ের দিকে ছুটে আসতে দেখলাম আমরা। ভিড় ঠেলে সে হয়ত আর সকলের মতই দেখতে পেল যে প্রায় ছ’ফুট লম্বা ইয়া এক মানুষ চিতিয়ে পড়ে আছে, চোখ দুটো বন্ধ, মাথার নিচ থেকে বয়ে গেছে একটা রক্তধারা। খবিরুল্লা আবার অনির্দিষ্ট কাউকে প্রশ্ন করে, “বাইচে আছে নাকি? শাউয়ো লোকটা মইরে গিছে না বাইচে আছে?” 

আমাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল, “ডাক্তার ডেকে আনা দরকার। আহা বেচারা গরমে সহ্য করতে না পেরে এইতো আমাদের চোখের সামনেই পড়ে গেল!” স্থানীয় হাইস্কুল কমিটির সভাপতি নবি সাহেব তার সুন্দর করে ছাঁটা চাঁপদাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “কী আর কবো। এই গরমে বাঁচা যায়? ছেলেডা কী সুন্দর হেইলে-দুইলে আসতিছিল খিয়াঘাটের দিকি। হুট কইরে কিরাম পইড়ে গেল। কিন্তু কাইগে ছুয়াল এইতি? চিন্তি পাত্তিছিনে। আহা রোদ্দুরে মরতি বসলো নাকি? ওই কিডা আছো, এগোই আসো।”

আবু রায়হান বেগতিক ভঙ্গিতেই রাস্তার ওপর পড়ে রইল। তার জরুরি কাজটি না জেনেও আমাদের কোন ক্ষতি হয়না। তবে তাকে ঘিরে শোরগোলটা থেমে যাবে এই আশা আমরা কেউই করিনা।

একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়ে ঠিক ওই মুহূর্তে আমাদের জটলাটিতে মিশে যায়। তারা এ গ্রামে এসেছে স্টার জুটমিলের তাঁত সেকশনের ওপর অ্যাসাইনমেন্ট করতে। ট্রলার থেকে নেমে ওরা হয়তবা ভিড়টি দেখে থাকবে আমাদের মত। আবিষ্কার করে থাকবে ছাইরঙ্গা ফতুয়া আর কালো প্যান্ট পরা এক লম্বা লোক চিত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। তার মাথার নিচের রক্তধারাটি গিয়ে শেষ হয়েছে একটি কচাগাছের নিচে। ভরদুপুরে পানির বদলে মানুষের টাটকা রক্ত পেয়ে কচাগাছটি খুশি কিনা কারও জানার উপায় নেই। তাছাড়া এর মাঝেই ওই রক্তের অনেকটা টেনে নিয়েছে গ্রীষ্মের হিংস্র জিভ।  

ছাত্রদলের কো-অর্ডিনেটর শিক্ষকটি মধ্যবয়সী। তার মাথাভর্তি চুল। এই গরমেও গায়ে সার্টিনের নিল শার্ট। প্রখর রৌদ্রে সেটি সমানে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। লোকটা অসম্ভব বেঁটে এবং তার গলার স্বরটি খনখনে। সেই খনখনে স্বরে শিক্ষকটি বলল, “হিটস্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা কী দিলরুবা?” স্বাস্থ্যবতী লম্বা চওড়া এক ছাত্রী এগিয়ে এসে বলল, “লোকটার মাথায় পানি ঢালব স্যার?” পঁচিশজন ছাত্রের দলটি পানির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। আশেপাশে নিশ্চয়ই কোথাও সুপেয় পানি পাওয়া যাবে, তৃষ্ণায় একেকজনের বুক ফেটে যাচ্ছে।

সে মুহূর্তেই নদীতে বিশাল একটি জাহাজী ট্রলারের আগমন টের পাওয়া যায়। দু’তীরে বিপুল জলরাশিময় ঢেউ তুলে সেটি দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। এ ধরনের ট্রলার সচরাচর ভৈরবের এই শেষ মাথায় দেখা যায় না। ন’মাসে ছ’মাসে দুই একটা চলে আসে আর এসেই সে ট্রলার নদীর জলে একটা হুলুস্থুল ফেলে দেয়। ঘাটে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের মাঝে যারা অল্প বয়সী তারা সেই হুলুস্থুলে পা ভেজায়, বয়স্করা নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে।

আমরা দেখতে পেলাম যে ওই পঁচিশজন ছাত্র-ছাত্রী পানির সন্ধান করতে গ্রামের ভিতরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে, বলাবলি করছে হিটস্ট্রোকের প্রধান চিকিৎসা পানি, রাস্তায় যে লোকটি চিতিয়ে পড়ে আছে পানি ছাড়া সে বাঁচবেনা।

অকস্মাৎ কে যেন আবু রায়হানকে চিনতে পারলো। “আরে এ তো জহুর ব্যাপারীর ছেলে। স্টারগেট বাজারে না দুটো শাড়ির দোকান আছে? আহা কী দবদবা দোকানরে ভাই। আর লোকটা নিপাট ভাল যাকে বলে। এমন লোক সচরাচর কি দেখা যায়?” তখন আমরা অনেকেই একমত না হয়ে পারলাম না। জহুর ব্যাপারী শুধু যে আমাদের চেনা তা নয়, বেশ রকমের চেনা। তার দোকান থেকে আমরা শাড়ি কিনি আমাদের নতুন কিংবা পুরানো বউদের জন্য, মায়েদের জন্য, স্কুল পড়ুয়া ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী কন্যাদের জন্য – আমাদের যেসব কন্যারা তাদের স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে শাড়ি পরবে এমন স্বপ্ন ক্লাস এইটে উঠেই দেখতে শুরু করে। কিন্তু জহুর ব্যাপারীর এরকম লম্বা-চওড়া একটা ছেলে আছে, এই কথাটা আমরা কিভাবে না জেনে থাকতে পারি?

ধীরে ধীরে আমরা আরও বুঝতে পারি, আবু রায়হান যে সে ছেলে নয়। রীতিমতো সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে এককালে। এ গ্রামে অমন মেধাবী কি দুটো ছিল কোনোদিন? ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে স্কুল কমিটির সভাপতি নবি সাহেব আফসোস করেন, “এমন হিরের টুকরো ছুয়ালডারে চিনতি আমাইগে এত দেরি হলো?” আবু রায়হান তো বড় হয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। তারপর স্কুল, কলেজ শেষ করে ঢাকায় চলে গেল পড়তে। এই কিছুদিন আগেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল ছেলেটার। শহুরে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে, সেই মেয়ে গ্রামে পড়ে থাকবে কোন দুঃখে? আবু রায়হান তাই শহরেই স্থায়ী নিবাস গড়েছিল নিজের শহুরে স্ত্রীকে নিয়ে। তাহলে এই পচা গরমে জহুর ব্যাপারীর সুপুত্রটি কিভাবে খেয়াঘাটের কাছে চিতিয়ে পড়ে আছে আজ?

ভিড়ের ফাঁকে একটা কুকুরের মুখও আবিষ্কার করি আমরা। মড়া মনে করে আবু রায়হানকে ওটা কামড়ে নিতে পারে এই দুশ্চিন্তায় কেঁপে উঠি সকলে। গরমে কুকুরগুলো পাগলপ্রায় হয়েছে। ওরা এসময় খাওয়ার অভাবেও থাকে। আমাদের মনে পড়লো গতকালের অথবা কোন এক দিন ঘটে যাওয়া সেই দৃশ্যটি। কী দ্রুতই না ঘটেছিল। খোলা রান্নাঘরে বসে আমাদের কারও বউ মুরগী কেটে-কুটে পরিষ্কার করে রেখে একটু উঠে গিয়েছিল কোন কাজে। ঐটুকু অবসরে আস্ত মাংসপিন্ডটি মুখে নিয়ে এক কুকুর মুহূর্তে অদৃশ্য হল আসেপাশে আরও অনেক মানুষের মাঝখান থেকে। আমরা কেউই নিশ্চিত হতে পারিনা যে আবু রায়হানকে নিয়েও ওই ভ্রু কুঁচকে অপলক তাকিয়ে থাকা কুকুরটিও সেরকম এক পরিকল্পনা কষছে কিনা।

তীব্র গরমের ভরদুপুরটা বুঝি বা স্থির সময়বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যায়। আবার আমাদের এও মনে হয়, দুপুরটা এক অনন্ত আগুনের চাদর, কে একে প্রসারিত করে দিচ্ছে প্রতিক্ষণে? বাতাস চলেনা। গাছের পাতা নড়ে না। ওপারে যাত্রী নেই বলে এপারে ট্রলার পৌঁছুতে দেরি হয়। আমরা যারা শহরের ওদিকে যাব, খেয়াঘাটের অদূরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকি। বৈশাখের মাঝামাঝি অথচ ঝড়ঝাপ্টার নাম নিশানা কোথায় মিলছে?

ঘাটের চিরকালীন বাসিন্দা খবিরুল্লা বেঞ্চের তলা থেকে বদনাটা উঠিয়ে নদীর দিকে নেমে যায়। ওতে পানি ভরে আবার হয়ত তাকে গোপন ঘরে যেতে হবে। আমরা জানি যে দু’দিন হলো পেট খারাপ করেছে তার। নকিব মেম্বারের মেয়েবিয়েতে সে নাকি আট টকুরো চিতল মাছ খেয়েছিল। হয়ত সে বদনায় ঘোলা জল ভরতে ভরতে আমাদের সঙ্গেই দেখে যে ঘাটে ট্রলার ভিড়ছে। সাকল্যে দশ বারোজন যাত্রী।

ট্রলার চলে আসায় আবু রায়হানকে ঘিরে জমে থাকা ভিড় পাতলা হতে শুরু করলো। আমরা বুঝতে পারলাম যে সকলেই ট্রলারে উঠবার কিংবা বাসায় ফেরার চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। ঠিক তখন আমাদের চোখের সামনে ট্রলার থেকে ঘাটে নামলো দীর্ঘাঙ্গ লোকটি। গায়ে ছাইরঙ্গা ফতুয়া, পরনে কালো সুতি প্যান্ট। হ্যাঁ, বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও আমরা মেনে নিতে বাধ্য হলাম যে এ লোকটিও আবু রায়হান। 

দিন-দুপুরে ভৌতিক এক আতঙ্ক আমাদের গ্রাস করতে চাইলে খবিরুল্লা আরও একবার চিৎকার করে উঠলো, “এ কি জিনিস? এইডে কুথা থেকে আসিছে?” কোনদিন কেউ দেখেনি তেমন বিশালাকার একটি কাক ঘাটের কাছে পা উঁচিয়ে পড়ে আছে। মৃত পাখিটার দিকে আমরা বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম। অতঃপর আমাদের দৃষ্টি ফিরে গেল আবু রায়হানের দিকে। ঘাটের ইজারাদারদের টেবিলে একটি মুদ্রা রাখলো সে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে মিলিয়ে গেল।


প্রথম প্রকাশ – অগাস্ট ২০১৫, বাংলানিউজ২৪.কম

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন