মনোজগতের বিউপনিবেশায়ন ও থিয়োঙ্গোর ভাষিক লড়াই

মনোজগতের বিউপনিবেশায়ন

আফ্রিকার দেশগুলোয় উপনিবেশের প্রভাব আমার মনে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন রকম ছিল। এর কারণ হতে পারে ভারতকে একেবারে একশ ভাগ বন্য জংলি বলে আখ্যা দিতে পারেনাই সাহেবরা। ভারতকে অনেকটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল এর প্রাচীন সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন। তারা দুই হাতে নিয়েছে আমাদের থেকে। শুধু সম্পদ নয়, জ্ঞানকাণ্ডও।

কিন্তু আফ্রিকার সম্পদ ছিল আরও বেশি, এবং আফ্রিকাকে শোষণ করতে গিয়ে তারা ঐ কাজটা করতে পেরেছিল, হেগেলের ভাষায়, ‘আফ্রিকা অন্ধকার, সেই জংলি নিগ্রোদের দেশে মানবিকতার আলো নিয়ে গিয়েছিল ইউরোপ।’ ইউরোপ এই মহাদেশটিকে মোটামুটি নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছিল। তারা রীতিমত এটা বিশ্বাসও করত যে এই সুবিশাল মহাদেশকে তারা উদ্ধার করছে।

আর এই উদ্ধারের ছদ্মবেশে শোষনকল্পের সবচেয়ে বড় টুল ছিল ভাষা। ইংরেজিকে তারা আফ্রিকার দেশগুলোয় চাপিয়ে দিয়েছিল। কেনিয়ার কথাশিল্পী ‘গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো (Ngugi wa thiong’o) যাকে এইভাবে দেখেছেন: স্কুলগুলোয় ভালো ছাত্র হওয়ার প্রধান উপায় ছিল ইংরেজিতে ভালো করা। ইংরেজি ভালো বললে পুরষ্কার, আর ইংরেজির বাইরে স্কুল কম্পাউন্ডে নিজের মাতৃভাষায় কেউ কথা পর্যন্ত বলতে পারত না, ধরা পড়ে গেলে জনসমক্ষে ছিল তার শাস্তির ব্যবস্থা। আর এর প্রভাব কেমন পড়েছিল, তার উদাহরণ দিতে বইয়ের একটা অংশ কোট করা যেতে পারে, “..অন্ধকারচ্ছন্ন আফ্রিকায় আলো নিয়ে এসেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও যিশু খ্রিস্ট। আমাদের বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলতেন শেক্সপিয়ার ও যিশু খুব সরল ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন; যতদিন পর্যন্ত কেউ তাকে এটি ধরিয়ে দেয়নি যে, যিশু আসলে কথা বলতেন হিব্রু ভাষায়। ইংরেজি সাহিত্যের ‘মহান ঐতিহ্য’ ছিল ‘সাহিত্যজগৎ’-এর মহান ঐতিহ্য!”

থিয়োঙ্গোর মতে, ষাটের দশকের যে বিখ্যাত আফ্রিকান লেখকেরা ইংরেজি ভাষায় আফ্রিকান মানুষদের নিয়ে সাহিত্য করেছেন, তারা এ মহাদেশের প্রধান সমস্যাটাই ধরতে পারেন নাই। যেহেতু ইংরেজি ভাষাটাই স্বয়ং এক উপনিবেশ, সেই ভাষায় লিখলে কি আফ্রিকার কোনো উপকার হবে বা এখানকার মানুষের সাংস্কৃতিক জাগরণ সম্ভব হবে? বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই ভাষা বিষয়ক তার যে বিস্ফোরক মুভমেন্ট, তা চিন্তার এই সরলরেখা ধরেই মূলত শুরু হয়েছিল।

অর্থাৎ, আফ্রিকার সাহিত্য কোনটা? ইংরেজি ভাষায় লেখা নিউওয়েভ আফ্রিকান লেখকদের সাহিত্য, নাকি সোয়াহিলি, জুলু, ইয়ারুবা, আমহারিক, আরবি ও অন্যান্য আফ্রিকান ভাষায় লেখা সাহিত্য?

‘গুগি থিয়োঙ্গো নিজেও আগে ইংরেজি ভাষায় লিখতেন। এবং তার ভাষা দিয়ে উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করার চিন্তা যখন ডেভেলপড হয়, তিনি নিজের মাতৃভাষা গিকুয়ুতে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। এবং ভাষার এই গুরুত্ব কতো বেশি, থিয়োঙ্গো সেটা টের পান যখন তিনি উন্মুক্ত মঞ্চে কেনিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য নাটক রচনা ও মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেন। নামে তখন কেনিয়া স্বাধীন, কিন্তু নিজেদের রাষ্ট্রই তাদের এই আফ্রিকান ভাষায় লেখা নাটকের মঞ্চায়নে বাধা দেয়। জেলে যেতে হয় থিয়োঙ্গোকে।

আফ্রিকার আসল ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে এর মৌখিক সাহিত্য, গান, কবিতা ও উন্মুক্ত মঞ্চনাটকের মধ্যে, আর উপনিবেশের সময় থেকেই এই জিনিসগুলোকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার যত রকম কাজ সম্ভব, ইউরোপিয়ানরা করেছিল। থিয়োঙ্গো ভেঙে ভেঙে দেখান, ইংরেজি ভাষায় রচিত আফ্রিকান মানুষের সাহিত্য কিভাবে ঘুরপথে সাহেবদের নীল নকশাকেই বাস্তবায়ন করে। ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় লেখা আফ্রিকার গল্প উপন্যাস ঠিক যেন আফ্রিকাকে সমৃদ্ধ করে না, এর মানুষের কথা বলে দূর থেকে, ভিতরে ঢুকতে পারে না। তাই খোদ চিনুয়া আচেবেকে আক্রমণ করতেও ছাড়েন না ‘গুগি। পাশাপাশি তিনি এও বলতে ভোলেন না, এত কিছুর পরেও নিজেদের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা হারায় নাই আফ্রিকার প্রান্তিক জনমানুষ। নিজেদের ভাষায় কথা তো তারা বলতোই, এমনকি প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও বাণিজ্যিক কাজে যে ইংরেজির ব্যবহার, সেই ইংরেজিকেও তারা নতুন একটা ডায়ালেক্ট-এ বদলে নিতে পেরেছিল।

পরবর্তিকালে পরীক্ষামূলকভাবে ইংরিজি ছেড়ে নিজের মাতৃভাষা গিকুয়ুতে যে উপন্যাস লেখেন তিনি, সেইটা লেখার পিছনে তার বড় উদ্দেশ্য ছিল এই – একদম সাধারণ লোকজন, শ্রমীক কৃষক যে কেউ যেন বইটা পড়তে পারে আর যারা পড়তে পারে না তাদের শুনাতে পারে। মানুষ যেন সচেতন হয়ে ওঠে এই নিয়ে যে, আফ্রিকান সভ্যতা ইউরোপের দান নয়, তাঁদের নিজেদের আছে স্বয়ং সম্পন্ন আপন পূরান ও সংস্কৃতি। ‘গুগির লক্ষ্য অনেকটাই পূরণ হয়েছিল। আর বইটা ওদের দেশেই এক বছরে প্রায় লাখখানেক কপি বিক্রী হয়েছিল যে সংখ্যাটা ছিল ঐ সময়ে কেনিয়ায় বা আফ্রিকার অন্যান্য লেখকদের ইংরেজিতে লেখা বইগুলোর চেয়েও বেশি।

সাহিত্য কি শুধু শিক্ষিত জনগণের হবে আর তাদেরই হবে যারা শুধু পড়তে পারে? সাহিত্যের ভাষা নিয়ে এই জায়গাটাই থিয়োঙ্গোর সবচেয়ে বড় শক্তি বোঝা যায়। সাহিত্য জনগণের থেকে দূরের কোনো বিষয় নয়, এর জনমূখিতা, জনসম্পৃক্ততা সম্ভব – এইটা নিজের জীবন দিয়েই তিনি মোটামুটি প্রমাণের চেষ্টা করে গেছেন।

মনোজগতে যে গেড়ে বসা উপনিবেশ, থিয়োঙ্গো দেখেছেন সেই উপনিবেশ থেকে আফ্রিকার সমস্ত মানুষের মুক্তি আসতে পারে নিজের মাতৃভাষায় নিজের দেশ নিয়ে চিন্তা করতে শিখলে।

বইটা নিরসও নয়, ‘গুগির রসবোধ কেমন, সে জন্য বইটির আরও একটা অংশ তুলে দিলাম, তিনি যেইখানে আলোচনা করেছেন ইউরোপের জনপ্রিয় সেইসব লেখকদের সম্পর্কে, যাদের বই আফ্রিকায় প্রচুর পরিমাণে পাঠ্য ছিল, আর এইসব বই কিভাবে নিজেদের নিয়েই আফ্রিকার মানুষদের মনে ভুল ধারণা নির্মাণ করে দিত, “..তৃতীয় ও সর্বশেষ শ্রেণিটি ছিল রাইডার হ্যাগার্ড, এলসপ্যাথ হাক্সলি, রবার্ট রুয়াক ও নিকোলাস মনসারাতের মতো লেখকদের পুরোদস্তুর বর্ণবাদি সাহিত্য। এ ধরণের সাহিত্যে আফ্রিকার মানুষদের দুটি ধরণ দেখা যেত, ভালো আর খারাপ। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের সহযোগিতা করা আফ্রিকার মানুষরা ভালো; বিশেষত যারা নিজেদের মানুষ ও দেশকে দখল ও পরাধীন করে রাখার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের সাহায্য করে।”

ভাষিক জাতীয়তাবাদ এক্সট্রিমের পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, আর পৃথিবীর সকল ক্ষমতাই ভাষাকে প্রধান অস্ত্র করে মানুষকে শোষণ করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এই বোধের কারণেই ভাষা বিষয়ক কট্টরপন্থি কোনো অবস্থানে হয়তো আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু এই বই পড়তে পড়তে সাহিত্যের ভাষা ও সাহিত্যের জনসম্পৃক্ততা (যে সাহিত্য কি শুধুই গুটিকয় মানুষের জন্য, নাকি জনমানুষের জন্যও) নিয়ে আমি নতুন করে ভাবার উপাদান পেলাম।

**বইটা পড়া হলো শিবলী নোমানের সাবলীল বাংলা অনুবাদে। প্রকাশ করেছে ইউপিএল

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন