ক্লাসিক সাহিত্যের সংশোধন কি পাঠকের সঙ্গে প্রতারণার নামান্তর? 

ক্লাসিক সাহিত্যের সংশোধন কি পাঠকের সঙ্গে প্রতারণার নামান্তর

এইচ পি লাভক্র্যাফট আধুনিক সাহিত্যে এক বড় নাম হয়ে হয়ে আছেন নানান কারণে। তার জগত অচেনা ভয়ের জগত।

মানব অস্তিত্বের খুব গভীরে নিজের অক্ষমতা ও ক্ষুদ্রতা নিয়ে যে হীনমন্যতা – সম্ভবত সেখান থেকেই জন্ম নেয় অজানার ভয়, এমন অজানা, যা বোধের অগম্যও, এমন সব অস্তিত্ব মানুষের আগে থেকেই পৃথিবীতে আছে, যেই ক্ষমতার সামনে দাঁড়ানোও মানুষের পক্ষে অসম্ভব, ভয়টা সেখানেও। যেমন কেউ কেউ পৃথিবী ও বিশ্বজগতের বিশালত্বের কাছে নিজের অতি ক্ষুদ্র অস্তিত্ব নিয়ে অসহায় বোধ করতে পারেন যার কোনো তল খুঁজে পাওয়া কঠিন।

মহাজাগতিক ভয়, অস্তিত্বসংকটের ভয় – সর্বপরি লাভক্র্যাফটিয়ান ভয়ের ধারণা শুধু ভৌতিক ও রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পেই নয়, এর অস্তিত্ব ও প্রভাব সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও দেখা যায়। এ কারণেই লাভক্র্যাফট লোকটা তাবৎ আধুনিক লেখক, চিত্রকর, সিনেমা পরিচালকদের কাছে নমস্য। আবশ্যিকভাবেই সেটা তার গল্পগুলোর অসাধারণ কল্পনাশক্তি ও মানব জীবনের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে নিঃসীম কৌতুহলের জন্যই।

তবে, আরও একটা নিশ্চিত বিষয়, যা ভয়ানক, স্বয়ং নিজের হৃদয়ে লালন করতেন লাভক্র্যাফট। তরুণ লাভক্র্যাফটের সেই কবিতাটিই তুলে দেওয়া যাক বরং। কবিতার নাম On the creatinon of Niggers।

‘When, long ago, the gods created Earth
In Jove’s fair image Man was shap’d at birth.
The beasts for lesser parts were next design’d;
Yet were they too remote from humankind?
To fill the gap, and join the rest to man,
Th’Olympian host conceiv’d a clever plan.
A beast they wrought, in semi-human figure,
Fill’d it with vice, and call’d the thing a NIGGER.’

এই কবিতার রেসিজম নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মাত্রাটা ভেবে দেখেন। লাভক্র্যাফট কল্পনা করছেন যে, ‘ঈশ্বর পৃথিবী তৈরি করেছেন, তারপর সৃষ্টি করেছেন মানুষ। এবং মানুষের পাশাপাশি খুব নিম্নস্তরের সৃষ্টি হিসেবে তৈরি করেছেন এক জন্তু বা উনমানুষ, যা অপরাধে পরিপূর্ণ, যাদের নাম ঈশ্বরেরা দিয়েছেন নিগ্রো/নিগার।’

সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্ম রেডিটে একবার একজন ব্যবহারকারী প্রশ্ন করেছিল, ‘লাভক্র্যাফটের লেখা থেকে রেসিজম বাদ দেওয়া সম্ভব কিনা?’

উত্তরে অন্য আরেকজন একটা প্রশ্নই করেছিল, ‘পাউরুটি থেকে ইস্ট কি বাদ দেওয়া সম্ভব?’

এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এওয়ার্ডকে ঘিরে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই এওয়ার্ডের ট্রফির ডিজাইনটা ছিল এইচপি লাভক্র্যাফটের মাথার আদলে। নাইজেরিয়ান আমেরিকান বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখক নেডি ওকরাফোর ২০১২ সালে এই পুরষ্কার জেতেন। তখন এক বন্ধু তাকে মনে করিয়ে দেন, ‘কিন্তু ট্রফিটা দেখো, লাভক্র্যাফটের আদলে তৈরি, ক্লাসিক লেখকদের মধ্যে তার মত রেসিস্ট আর দুইটা পাবা?’

হতাশার সাথে এই সত্য মেনে নিতে দেরি হয় না ওকরাফোরের। নিজের ব্লগে তিনি লেখেন, ‘এই চরম বর্ণবিদ্বেষি লোকের মাথাটা এখন আমার লেখক জীবনের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার।’

আমেরিকান সাহিত্য জগতে এই চরম সত্যটি আলোচিত হতে শুরু করে নতুন রূপে, যা চেপে রাখার চেষ্টা মিডিয়া ও বইয়ের জগতের মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছিলেন।

অবশেষে, ২০১৫ সাল থেকে এই পুরষ্কারের নকশায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় পুরষ্কার কমিটি।

তবে পপ কালচারে লাভক্র্যাফট ক্রমেই আরও জনপ্রিয় হচ্ছেন। পাশাপাশি তার বর্ণবিদ্বেষের বিষয়টিও আলোচিত হয় আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

এ বিষয়ে বেশ মেইন্সট্রিম একটা টিভি সিরিজ লাভক্র্যাফট কান্ট্রি। ম্যাট রাফের লাভক্রফটিয়ান থিমের উপর লেখা (প্রাচীন গুপ্ত সংস্থা, কাল্ট, ম্যাজিক) একই নামের উপন্যাস থেকে নির্মিত এই সিরিজে মূলত বর্নবিদ্বেষের কড়া সমালোচনাই করা হয়েছে।

ভূমিকা শেষ। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।

আধুনিক প্রকাশকেরা কোনো ক্লাসিক লেখকের অরিজিনাল টেক্সট থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মূল লেখকের রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, ও আর্থসামাজিক চিন্তাভাবনা ছেঁটে ফেলতে পারেন কিনা, বা এমন করলে তা পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল কিনা, আমার আজকের লেখার এটাই আলোচ্য বিষয়।

প্রথমেই বলা যাক বৃটিশ সাহিত্যিক রোয়াল্ড ডালের বইগুলোর নতুন পাফিন এডিশনের কথা। অভিযোগ আসে যে, ডালের উপন্যাসগুলোয় একশোরও বেশি জায়গায় সংশোধনের নামে পরিবর্তন করেছে পাফিন সম্পাদনা পর্ষদ, যারা আসলে পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউজেরই একটা সাবডিভিশন। তাদের মতে, বাচ্চারা যেহেতু এই বইগুলো পড়বে, লেখকের ব্যবহৃত বডিশেমিং উস্কে দিতে পারে এমন শব্দ বা নারীদের ছোটো করে দেখা হয় এ ধরণের বিষয়গুলো বদলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

যেমন, চার্লি এন্ড দ্যা চকোলেট ফ্যাক্টরিতে ‘বিশাল মোটা’ শব্দদ্বয়ের বদলে রাখা হয় শুধু ‘বিশাল’ শব্দটি, ‘মোটা’ বাদ দেওয়া হয়। উইচেস উপন্যাসের কোনো ডাইনী হয়তো সাধারণ নারীর বেশে একটা সুপারশপের ক্যাশিয়ার বা কোনো পুরুষ ব্যবসায়ীর টাইপিস্ট হিসেবে কাজ করে, আধুনিক এডিশনে তাদের পেশা বদলে দিয়ে করে দেয়া হয় খ্যাতিমান বিজ্ঞানী বা ডাকসাইটে নারী উদ্যোক্তা।

পাফিনের সংশোধন নিয়ে আরেক বৃটিশ উপন্যাসিক সালমান রুশদি তো বলেই বসেছিলেন, ‘ডাল তো আর ফেরেশতা নন। তবে প্রকাশকের পক্ষে এমন সেন্সর করাটা খুব দৃষ্টিকটু ও নির্লজ্জ আচরণ।’

তবে জানা যায়, রোয়াল্ড ডাল নিজেও চার্লি এন্ড দ্যা চকোলেট ফ্যাক্টরির ১৯৬৪ সালের সংস্করণে কিছু সংশোধন করেছিলেন। তবে সেটা প্রকাশকের চাপে। বইটা যারা পড়েছেন, তারা অনুমান করতে পারছেন।

এই উপন্যাসের কমিক ইলিমেন্ট দুষ্ট প্রকৃতির বেঁটেখাটো উম্পালুম্পারা প্রথমত ছিল আফ্রিকান পিগমি। পরে ডাল এদের অরিজিন বদলে দিয়ে লুম্পাল্যান্ডের বাসিন্দা করে দেন।

রোয়াল্ড ডাল থেকে আসুন এবার চলে যাই ভুবনবিখ্যাত এসপিওনাজ জেমস বন্ডের জগতে।

ইয়ান ফ্লেমিংয়ের এই উপন্যাস সিরিজের ৭০-বছরের বিশেষ সংস্করণ প্রকাশের আগে দাওয়াত দিয়ে আনা হয় বিশেষ এক শ্রেণীর পাঠকদের, যারা কিনা অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর ও অনুভূতিপ্রবণ।

এনাদের বলা হয় খুঁজে খুঁজে রেসিস্ট বা আধুনিক যুগের হিসেবে আপত্তিকর অংশগুলো বের করতে। ধরা যাক, বন্ড এক জায়গায় আফ্রিকান সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে বলছে, ‘আমি ভেবেছিলাম শুধু মদ্যপ অবস্থাতেই ছোকরাগুলো বেশ আইন-কানুন মেনে চলে।’ লাইনটা বদলে দেওয়া হয় এইভাবে, ‘আমি ভেবেছিলাম ছোকরাগুলো বেশ আইন-কানুন মেনে চলে।’

বন্ডের উপন্যাসগুলোয় নারী ও সমকামীদের অবস্থান আরও শোচনীয়। ‘সেক্সিজম’ ও ‘হোমোফোবিয়া’ এসব বইয়ে এমন ভাবে মিশে আছে যে, ওসব বাদ দিলে বন্ড আর বন্ড থাকে না। তাই আর ওগুলোর পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। অনেকটা আমাদের আলাপের শুরুতে লাভক্র্যাফটের সাহিত্য সম্পর্কে যেমন বলেছিলাম – ফল ছাড়া জুস হয় না, ইস্ট ছাড়া হয় না রুটি।

এইরকম ঘটনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। যেমন আগাথা ক্রিস্টির বইগুলো, আমাদের হাতে আজ মেরে কেটে যে অবস্থায় আসে, সেসবের অধিকাংশ থেকেই খুব হিসেব করে ছেঁটে ফেলা হয়েছে তুমুল বর্ণবিদ্বেষী শব্দ ও বর্ণনাগুলো। ধরা যাক, ডেথ ইন দা নাইলের কথাই। উপন্যাসের একটি চরিত্র মিসেস এলার্টন, তার সঙ্গে দুষ্টামি করতে থাকা একদল মিশরীয় শিশুকে দেখে বলেন, ‘ওদের চোখগুলো বিরক্তিকর, যেমন ওদের নাকগুলোও।’

আগাথার বই নিয়ে আলাপ করতে বসলে এ লেখা আরও বড় হয়ে যাবে, তাই এখানেই ক্ষান্ত দিচ্ছি আপাতত।

সম্প্রতি পেঙ্গুইন থেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বইগুলোর নতুন একটা সংস্করণ বের হচ্ছে। প্রকাশকের তরফ থেকে বইয়ের শুরুতে বসানো হয়েছে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বাণী –

এই বই ১৯২৬ সালে প্রকাশিত এবং এর সমসাময়িক ভাবনাচিন্তা ধারণ করে। প্রকাশকের তরফ থেকে বইটি অপরিবর্তিত অবস্থায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত কোনো ভাবেই এ বইয়ে আলোচিত বিষয়বস্তু ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করা নয়।

উপরে আমরা ক্লাসিক সাহিত্যের ‘আধুনিক সংশোধন’ বিষয়ক যে আলাপ করলাম, এ আলাপের চিন্তা আমার মাথায় আসে মূলত হেমিংওয়ের বইগুলোর উপর নতুন করে বসানো এই ট্রিগার ওয়ার্নিং দেখেই। অর্থাৎ কিনা, আগেভাগে বলে দেওয়া হেমিংওয়ে লোকটা মন্দ, হিসেব করে তাকে পড়তে বসবেন।

পাঠকের যেখানে নিজের মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা আছে, এই ধরণের ট্রিগার ওয়ার্নিং সেই স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বা বিদ্রূপ করে কিনা, থেকে যায় সেই প্রশ্ন। ক্লাসিক সাহিত্য বা বই তো সিগারেটের প্যাকেট নয়।

যদিও, ক্লাসিক টেক্সট-এর এই ‘সংশোধিত’ অবস্থা বা এই প্রচেষ্টাকে খালি চোখে দেখলে কারও কাছে স্বাভাবিক মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, বইয়ের কাজ তো মানুষকে মহত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া। তো, আধুনিক সময়ে বর্ণবিদ্বেষের বিপক্ষে, বা বডিশেমিং ও নারীবিদ্বেষের বিপক্ষে আমাদের যে অবস্থান, ক্লাসিক বইগুলোকে শুদ্ধ করে দেখাতে পারলে তো নতুন যুগের পাঠকদের উপকারই হতে পারে। আসলেই কি তাই?

এ ধরণের ‘সংশোধনে’ দুটি বড় রকমের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে । এক, লেখকের আসল দৃষ্টিভঙ্গী পাঠকের জানা হয় না। দুই, যে সময়ে বসে লেখক মূল লেখাটি লিখেছেন, সে সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে পাঠক জানতে পারেন না।

ধরা যাক, আগাথা ক্রিস্টি রেসিস্ট নন (ধরে নিচ্ছি উদাহরণ দেওয়ার সার্থে), কিন্তু অকপটে একজন রেসিস্ট ধরণের চরিত্রকে নিয়ে লিখছেন। আফ্রিকান শিশুদের চোখ সেই রেসিস্ট চরিত্রের কাছে বিরক্তিকর লাগাটা স্বাভাবিক এবং তা অকপটে তুলে ধরা তো লেখকের সততাই। বইটির আধুনিক সংস্করণগুলো মুলত সেই সাহিত্যিক সততাকে নষ্ট করে আমার ধারণা।

সাহিত্য আসলে কী? নীতিবাক্যের তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম নাকি যুগে যুগে বিকশিত হতে থাকা হিউম্যান কন্ডিশন ও সমাজ সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় দলিল? এই সময়ের প্রকাশক ও সম্পাদকদের হাতে ক্লাসিক সাহিত্যের সংশোধনবাদিতা এই প্রশ্নের মুখে আজ আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়।

তখন মনে হয় সদা টনটনে অবস্থায় পলিটিকাল কারেক্টনেস মেনে চলার অপচেষ্টা আমাদের সময়ের সৃজনশীলতাকে, এমনকি অতীতকেও গিলে খেয়ে নিতে চায়, নিচ্ছেও কি?

পাদটিকা:

এই লেখার নাম দিতে চেয়েছিলাম – ‘পশ্চিম কি ক্লাসিক সাহিত্য সংশোধনের মাধ্যমে তাদের ইতিহাসের অন্ধকার দিকগুলো মুছে ফেলতে চায়?’ তবে, বর্তমান শিরোনামটি যথার্থ তরল মনে হওয়ায় সেটাই রাখলাম।

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন