ভাসা ভাষায় কয়েক ছত্র ডিকেন্স দেবেশ সেলিম

ওল্ড কিওরোসিটি শপ

গল্পবলিয়ে সেলিম মোর্শেদ

সেলিম মোর্শেদের লেখালেখির সঙ্গে আমার পরিচয় বছর দুয়েক আগে। তিনি লিখছেন অনেকদিন ধরেই, আমি পড়ছিও অনেক দিন ধরেই। তবু আমাদের যোগাযোগ হতে এত এত দেরি হবার নিশ্চয় কারণ ছিল।

বইমেলায় উলুখড়ের স্টল থেকে তার শ্রেষ্ঠগল্প কিনেছিলাম। কাটা সাপের মুণ্ডুর মত বইটা শেলফে ঘুমল কিছুদিন। এরপর হুট করেই একদিন পড়তে শুরু করি। ছোটগল্প যেহেতু টানা পড়ার উপায় কমই, আমি একটা একটা করেই পড়ছিলাম। কাটা সাপের মুণ্ডু, নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল, দি পার্ভার্টেড ম্যান কিংবা সুব্রত সেনগুপ্ত।

নব্বই দশকের একটা কেমন ধুসর অনুভূতি গল্পগুলোতে মিশে আছে। যখন লেখা হয়েছিল তখন নিশ্চয় এই বর্ণ উজ্জ্বলই ছিল। এখন যেহেতু ঐ সময়টা নষ্টালজিয়ার, তার রঙও ধুসর হয়ে উঠল।

পড়তে ভাল লাগে। গল্পগুলো রসকষহীন না। সবচেয়ে যা ভাল লাগল, লেখকের সমাজ দর্শনের আরক এগুলোয় মিশে আছে কিন্তু মিশে যাবার প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক, চাপিয়ে দেয়া মনে হয়না। গদ্য যেমন সরল, গতিও আছে, আবার কোথাও কোথাও দেখি অস্পষ্ট কবিতার ছায়া।

লিটলম্যাগ সংশ্লিষ্ট মানুষজন ছাড়া সেলিম মোর্শেদকে তেমন কেউ চেনেন না। লেখকের নিজেরও এমন ইচ্ছে ছিল বোধকরি। নিজের মেধা ও শক্তির যায়গাটা তিনি দান করতে চেয়েছেন লিটলম্যাগকে।

অথচ লিটলম্যাগকে আমার মনে হয় সাহিত্যের মেসঘর। বাধ্য হয়েই সবাই থাকে, ছুটির রাতে মদ অদৃশ্য হয়, সিগারেট গাঁজা পোড়ে, কারও বা বউ ডাহুকের মাংস রান্না করে পাঠায় গ্রাম থেকে কোন দিন, ফোনে পাওয়া যায় আব্বা-আম্মার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। সবাই থাকে এখানে, থাকতে হয় তাই, কিন্তু থাকতে কেউ চায়না, কারণ সময়ের গতি এখানে থমকে যাবে আর ভবিষ্যতে অনেক অনেক স্মৃতির জন্ম দেবে – এ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য তার যেন নেই, উপায়ও নেই।

তবু বই হয়ে তার লেখাগুলো বের হয়েছে মানেই এগুলো ওয়াইডার অডিয়েন্স চায়। পাবেও মনে হয় এক সময়। সেলিম মোর্শেদের উপন্যাস পড়ার অপেক্ষায় থাকা যাক আপাততো।

সময় অসময়ের বৃত্তান্তে দেবেশ রায়

দেবেশ রায়ের “সময় অসময়ের বৃত্তান্ত” পড়তে গিয়ে নিজের একটা পর্যবেক্ষন নোট করেছিলাম।

তা হল – আপনি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করবেন যে এই বই আপনার আলাদা মনোযোগ দাবি করে, এবং পড়ে শেষ করতেই হবে এমন চাপ নেবেন না। প্রথমে মনে হবে লেখক খুব ঘুরাচ্ছেন, গল্পে যেতে চাইছেন না। কিন্তু এক সময় বুঝবেন, সরাসরি গল্প বলা লেখকের উদ্দেশ্য না। কাদামাটি দিয়ে লেখক তৈরি করবেন পুতুল, এরপর সেই পুতুলগুলোতে দেবেন প্রাণ, আর প্রাণ পেয়ে জীবন্ত চরিত্রগুলো সেইসব কাজ করবে যা লেখক প্রায় শুরুতেই আপনাকে আকারে ইঙ্গিতে বলে দিয়েছেন।

এখন কীভাবে এই চরিত্রগুলো তাদের অভিজ্ঞতার মাঝখান দিয়ে আপনাকে তাদের ভুবন দেখাবে, এটা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। একেকজন একেক পদ্ধতিতে বুঝতে পারে।

আরেকটা কথা, লেখক কি চরিত্রগুলোর হাতে আপনাকে একেবারে ছেড়ে দেবেন? না, পুরো আখ্যানেই কম বেশি তাকে আপনি পাবেন গাইড হিসেবে। যেন উপন্যাসটি তার লেখা না, তবে আখ্যান ও চরিত্রগুলোর উপর তার এক ধরণের নিরুত্তাপ আগ্রহ আছে।

ওল্ড কিওরিসিটি শপ

ভিক্টোরিয়ান সময়টার প্রতি তুমুল আগ্রহ ছাড়া এই যুগে বসে ডিকেন্স পড়া ঝুঁকির। মনে হবে লোকটা শব্দে-বাক্যে অলঙ্কার তৈরি করতে গিয়ে বেশি পেঁচান আর বেশি বকবক করেন।

ওল্ড কিওরিসিটি শপ পড়তে গিয়ে শুরুর দিকে এমন মনে হচ্ছিল আমার। উপন্যাসের ভিলেন কুইল্পকে রীতিমত ইচ্ছে করেই যেন কুৎসিত চেহারা ও আকৃতি দিয়েছেন।

কিন্তু যে রাতটিতে সব হারিয়ে ফেলা লিটল নেলি আর তার দাদা কাউকে না জানিয়ে নিঃশব্দে বের হয়ে পড়ল অজানা আগামীর দিকে, আমি কিছুটা বুঝলাম মানুষ কেন এত ভালবাসত ডিকেন্সকে।

ভাল না বেসে উপায় নেই। কুৎসিত কুইল্প মনে ও শরীরে, কিন্তু সুদর্শন যে মানুষ – তাদের মনও কেন এমন হিংস্র আর স্বার্থের ইশারায় চলে?

মানুষ আইডিয়াটাই মানুষের গড়ে তোলা, একই ভাবে ভাল ও মন্দের আইডিয়াও। শুধু মানুষ একটু ভালবাসবে মানুষকে, তাহলে হয়ত লিটল নেলের পবিত্র সৌন্দর্যকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে উদ্ধার করা যাবে। হয়ত।

এমন অসম্ভব উদ্দেশ্য ধরে রেখেও কীভাবে যুগে যুগে পাঠককে আনন্দ দেওয়া যায়, ডিকেন্সের কাছ থেকে তা শিখে নেওয়ার আছে। তার সবচেয়ে বড় দুর্নাম, সেন্টিমেন্টালিটি, ঐ ব্যাপারটিকেও আমাদের সময়ে আর কোনভাবেই খাটো করে দেখা যায়না।

আধুনিকতা ও মেশিনারিজের পৃথিবীতে আমাদের এমন হার্ডবয়েল্ড বেঁচে থাকায় ঐ সেন্টিমেন্টালিটিকে আশ্রয়ের মত লাগছে।


লেখার ক্রমধারা –

অগাস্ট ১১, ২০২০

জুন ০৭, ২০২০

অগাস্ট ২২, ২০২০

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন