[২০১৭ সালের শেষের দিক থেকে ২০২৩ এর শুরু। এই হলো সামগ্রিকভাবে চায়ের কাপে সাঁতার উপন্যাসের রচনাকাল। এর মাঝে শেষ এক বছর গিয়েছে পাণ্ডুলিপির সম্পাদনায়। নিচের লেখাগুলোকে ঠিক দিনলিপি বলা যায় না, দীর্ঘ রচনাপ্রক্রিয়ায় কোন একটা স্তর অতিক্রম করার পর আমি টুকরো টুকরো ভাবে সেই সময়কার অনুভূতিগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। বই প্রকাশিত হয়ে গেছে ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারিতে। পৌছে গেছে পাঠকের হাতে। এই পেজটাও রইলো পাঠকদের জন্যই।]
‘চায়ের কাপে সাঁতার’ প্রেস থেকে বেরিয়ে মাত্র প্রকাশকের হাতে এসেছে। কিছু আগেই সংবাদটা পেলাম আর আমার পৃথিবী বদলে গেলো। আমাদের এই আলোর মত দ্রুত বেগে ছুটে চলা শতাব্দীতে প্রকাশিত এই উপন্যাস প্রস্তুত পাঠকের স্মৃতির বাগানে জায়গা করে নেওয়ার জন্য, তার চিন্তার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য, এমনকি, হয়তো, তার চিরায়ত মানসের অংশ হয়ে ওঠার জন্যেও।
গতকাল সুবিমল মিশ্রের মৃত্যু প্রসঙ্গে আলাপে আব্দুল্লাহ আল হারুন স্বজন একটা মন্তব্য করেছিলেন, ‘লেখক তো বটেই, আমার মনে হয় আর্টিস্ট মরার পরেই তার আর্ট পুরোপুরি পাবলিক প্রপার্টি হতে পারে।’
আমার উত্তরটা এর পক্ষে হলেও কয়েক লাইন বিশদ ছিলো, তা এই –
‘বই বেরিয়ে যাওয়ার পরেই সেই লেখা পাঠকের আসলে। এই অর্থে লেখকের সৃষ্টি সব সময় আসলে পাঠকেরই সম্পত্তি। আর মৃত্যুর পর, ঐ অর্থে জিনিসটা কার্যকর হয় যে নিজের লেখার পক্ষে লেখকের আর কিছু বলার থাকে না, বইটাই তার চূড়ান্ত কন্ঠস্বর, আর পাঠক তার পক্ষে বিপক্ষে দাঁড়ায় একেবারে স্বাধীন হয়ে।’
চায়ের কাপে সাঁতার এখন পর্যন্ত আমার তেরো বছরের লেখক জীবনের চূড়া। যতটা চিন্তা ও কল্পনার জগতে আমার বিকাশ ঘটেছে এই দীর্ঘ যাত্রায়, গল্পের কৌশল ও আতশ কাঁচে যেভাবে জগত ও এর প্রতিটি উপাদানকে আমি দেখেছি, মানুষকে যেভাবে আবিষ্কার করেছি পৃথিবীর পথে, আর আমাদের আয়ুরেখা, সম্পর্ক, যৌনতা, স্মৃতি ও মৃত্যুকে যতটা অনুভব করতে পেরেছি ইতিহাস, রাজনীতি, ক্ষমতা ও সমাজ ব্যবস্থার রাজপথ আর গলিঘুঁজি ছিড়ে-খুঁড়ে – এই প্রায় এক লক্ষ বত্রিশ হাজার শব্দের উপন্যাস, প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠা যার ব্যাপ্তি বইয়ের চেহারায় – সেখানে ধরা রইলো।
আমার দিক থেকে পাণ্ডুলিপির সমস্ত কাজ শেষ হল আজ।
কিছুটা আতঙ্ক এসে ভর করে, যখন চিন্তা করি যে কেমন দুঃখজনক ব্যপার হত যদি প্রথম সেটাপের অজস্র ভুলভ্রান্তিসহ উপন্যাসটা বেরিয়ে যেতো বাইশ সালের বইমেলায়।
প্রুফ দেখার পর সম্পাদক সাধারণত সেটাপ দাঁড় করান। সেই স্টেজের পরে গিয়ে লেখকের একটা রিভিশনের পর্যায় থাকে। এই সুযোগটা পাওয়া গেলো, ঐ তাড়াহুড়ায় বইটিকে গ্রিনলাইট না দেওয়ার এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তের জন্য।
এত বড় পাণ্ডুলিপির এই পুনরায় রিভিশন আর মন্তব্য যোগ করার কাজ কী যে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের, কখনও কখনও হতাশার, এবং শেষ পর্যন্ত কেমন আনন্দের – তা বুঝিয়ে বলা কঠিন।
প্রচ্ছদের কাজও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল মার্চের শেষের দিকে। কী উপায়ে তা সবার সঙ্গে শেয়ার করার ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখেছি জানা নেই।
উপন্যাসটি প্রকাশিত হবে ‘আদর্শ’ থেকে।
এমন একটা উপন্যাস লিখবো, শুরুর দিকে ভাবতাম, যেটা হবে মাত্রাছাড়া, উন্মাদ ধরণের এবং বন্য। স্বভাবতই আমি চাইছিলাম ডার্ক কমেডির টোনে ঢাকার একটা ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ডকে ধরতে।
দিনের পর দিন আমি লিখে গিয়েছি। ব্যক্তিকে ধরে ধরে। সুতরাং যে দৃশ্য ও গল্পগুলো একটা পাখির চোখে উপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, ধীরে ধীরে তা হয়ে যেতে লাগলো ব্যক্তির অভিজ্ঞতা আর পর্যবক্ষণের সমষ্টি। ক্লোজ কল।
আর যা হয়, মানুষ যখন তার মনের চোখ দিয়ে দেখে, মনের গোপন সব দরজা খোলার চেষ্টা করে, অনেক দরজা খুলেও যায়। বেরিয়ে আসে সুন্দর অসুন্দর দুটিই। এরা আসে প্রাণীর রূপ ধরে। কোন আলো হয়ত একটা ডানাওয়ালা ঘোড়ার মত, তো কোন অন্ধকার নিঃসন্দেহে বিশাল আকারের ষোল হাত-পাঅলা কুৎসিত জন্তুর মত, অস্তিত্বকে আঁকড়ে ধরে, কাঁপিয়ে দেয় আতঙ্কে।
স্বভাবতই যেভাবে পরিকল্পনা আমি করেছিলাম, তাকে ভেঙেচুরে দিয়ে কাজটা এগিয়েছে নিজের মত। প্রতি বছর মনে হত, আমি যে গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছি, তা থেকে কি শেষ পর্যন্ত আর বের হতে পারবো?
ভাগ্য আমার সহায় হয়েছে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর। ধাঁধার সব ছড়ানো লুকনো সুতো খুঁজে বের করার অনুসন্ধানকে আমি এক বিন্দুতে অবশেষে হয়ত মিলিয়ে দিতে পেরেছি, এমন এক ভুল ধারণা নিয়ে উপন্যাসটা শেষ করেছি লিখে। হয়ত।
বিষয়বস্তু নিয়ে একটু বলি। মূল চরিত্রের একটা বয়স থেকে আরেক বয়সে উঠে আসার ঘটনা আছে, তাই একে বিল্ডান্সরোমান বলা যাবে। দর্শন ও রাজনৈতিক বোঝাপড়া আছে। আর মিলেমিশে গিয়েছে ফ্যান্টাসির গোপন উপাদান।
একুশ শতকে রাজকুমারী শেহেরজাদ যদি রাজা শাহরিয়ারকে গল্প শোনাতো, সেই গল্পটি কেমন হত? আমি চিরকাল ভেবে এসেছি আরব্য রজনীর গল্প বোনার কৌশলের মত বিস্ময়কর খুব কম জিনিসই আছে পৃথিবীতে। দুইজন বৃদ্ধ ও দুইজন তরুণের চোখে বর্তমান ও ইতিহাসের বোঝাপড়ার মাঝখানে হয়ত মিশে গিয়েছে আরব্য রজনীর সুদীর্ঘ ছায়াও।
শুধু গল্প লেখা উপন্যাসিকের কাজ তো না। অজস্র গল্পের সাহায্য নিয়ে লেখক দেখতে চান মানুষ শেষ পর্যন্ত কেমন আচরণ করে জীবনের বিচিত্র সব পরিস্থিতিতে। সে কি ঘটনার কেন্দ্র নাকি অংশ? নাকি কেন্দ্র আর অংশ দুটোই? আমি আমার এক লক্ষ ত্রিশ হাজার শব্দের উপন্যাসে এসবই খুঁজে বের করতে চেয়েছি। সেই চেষ্টা কেমন কী হয়ে উঠলো, তা এখন আমি অন্য মানুষের চোখ থেকে জানতে চাই।
নতুন উপন্যাসের দুই ধাপ সম্পাদনা শেষ হল। একটা রিডেবল ভার্শন তৈরি হয়েছে। বেটা রিডারদের খসড়া কপি পাঠানোর মত একটা চেহারা দাঁড় করানো গেল বলেই মনে হয়। শব্দ সংখ্যা অনেক ফ্ল্যাকচুয়েট করেছে এই পুরো সময়টিতে। অতঃপর স্থির হয়েছে এক লক্ষ সাতাশ হাজার শব্দে।
কী নিয়ে লিখলাম এতগুলো বছর ধরে? কিছু মানুষের অনেক রকম জীবন। অনেক রকম গল্প। সময়ের বৈচিত্র্য আছে, যদিও চরিত্রগুলোর জন্য দরকারি একটা টুলস হিসেবে। বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হিউম্যান কন্ডিশনকে বুঝে উঠতে চেষ্টা করেছি। সকলের গল্পগুলো কোন একটা বিন্দুতে এসে মেলে কী না, বাজিয়ে দেখতে চেয়েছি সেটাও। আমার পুরাণ ও দর্শনের বোঝাপড়া, সমাজ বীক্ষা, থ্রিলারের উপাদান আর ফ্যান্টাসী সবকিছুই হয়ত মিলেমিশে গিয়েছে। ঠিক কোন জঁরায় কাজটিকে ফেলা যাবে বলা কঠিন।
আমাদের সময়ে এসে উপন্যাসিকের কাজটা ঠিক কেমন? সেই বোঝাপড়ায় আসতেই হয়ত সময় লেগে গেল এত। আসতে পারলাম কী না, সে নিশ্চয়তা কখনও ছিল না, থাকেও না।
আমি অস্থিরমতি নই। আবার ধ্যানে বসার কলকব্জাও আমার কম। কিন্তু নিজের অহমকে হারতে দিলাম কই? প্রথম বইয়ের পর ছয় বছর কেটে যাচ্ছে, লিটারারি সিনে আমি থেকেও নেই। একটা কাজের সঙ্গে লেগে থাকার এই ধৈর্য আমাকে কে দিল, তা খুঁজে বের করতে গেলেও হয়ত আরও এক উপন্যাস লেখা যাবে। সেই বিচিত্র ভ্রমণের গল্প আমি সামনে কখনও লিখব। আপাততো, মাস খানেকের রেস্ট। যথাযথ প্রকাশকের সঙ্গে ব্যাটেবলে মিলে গেলে এই উপন্যাস দ্রুতই আলোর মুখ দেখবে সেই আশা রাখি। আর কত অপেক্ষা করা যায়।
উপন্যাসটা লিখে শেষ করা গেল অবশেষে। প্রায় চার বছরের জার্নি। এর মাঝে জীবন কত কিছুর মাঝখান দিয়ে গেল। পৃথিবী কত কিছু দেখল। লেখক হিসেবে যে যাত্রা আমি পার করলাম, তা নিয়েও হয়ত একটা আলাদা উপন্যাস লেখা যাবে। সামনে কী আছে জানিনা। তবে আগামী কয়েক মাসের জন্য পান্ডুলিপিকে গ্রীষ্মের অবসরে পাঠিয়ে আমি জিরিয়ে নিতে চাই। এক লাখ একুশ হাজার শব্দ। সম্পাদনার মহাযজ্ঞ নিয়ে এখন আর ভাবতে চাইনা। সকলের মঙ্গল হোক। আনন্দ হোক।
এক লক্ষ শব্দ লিখতে গত তিন বছরে কী কী খরচ হয়ে গেল জীবনে সেই হিসেব যেমন করতে ইচ্ছে যায়, এক লক্ষ শব্দের কারণে নিজেকে পৃথিবীর সবিচেয়ে ধনী মানুষও মনে হয়। যেহেতু প্রথম সব কিছুই বিশেষ, এই ছোট্ট স্টেটাসে এত বড় আনন্দের বিষয়টা নোট করে রাখলাম।
জুলাই ২৫, ২০২০
যাত্রাটা অনেক দীর্ঘ। তিন বছর কেটে গেছে। ভেবে ভাল লাগছে যে প্রায় গুছিয়ে আনা গেল অবশেষে। অন্তত এখন মনে হচ্ছে ঠিক লাইনে আছে নতুন উপন্যাসের সমাপ্তি। শেষ কয়েকটা অধ্যায় লিখব। লিখছিও প্রতিদিন একটু একটু করে।
হোম কোয়ারেন্টিন তো রেস্টলেস করে রেখেছে। এই সুদীর্ঘ স্বপ্নের মত বইটি যদি লিখে শেষ করতে পারি, কিছুটা শ্রান্তি পাবে জীবন। লাখখানেক শব্দ লিখেছি, আনুমানিক আরও ত্রিশ হাজার শব্দ হয়তবা লিখতে হবে। এত বড় পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার মহাযজ্ঞ আছে। সে পরের ধাপ। এখন ভাবছিনা।
নতুন উপন্যাসের কাজ শেষের পথে। তিন বছর কীভাবে কেটে গেছে, আর আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পাঁচ বছর! তিন আর পাঁচ দুটিই প্রাইম নম্বর।
Books choose their authors; the act of creation is not entirely a rational and conscious one.
– Salman Rushdie
নতুন উপন্যাস নিয়ে আমার পরিকল্পনা ছিল যে তিনটি পর্বে ভাগ করে আখ্যান সাজাবো। এ বছরের জানুয়ারির শেষাশেষি শুরু করেছিলাম। আনুমানিক নব্বই হাজার শব্দ, এরকম পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে টানা লিখে গেলে ফার্স্ট ড্রাফট নামতে তিন থেকে চার মাসের বেশি সময় লাগবার কথা না।
কিন্তু সেই সুযোগ কোথায়, টানা লিখে যাবার অবসরই বা কই? চাকরি করতে হয়, তা ছেড়ে দেবার মত সুযোগ পারিবারিক কারণেই অসম্ভব। তবু তো লিখতে হবে। আমি টুকটুক করেই লিখতে শুরু করেছিলাম। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল দিনের পর দিন লিখতে না পারবার ক্লেশ। কখনও একমাসে ছয় হাজার শব্দ লিখেছি, কোন মাসে দু’হাজার তো দু’মাস পাণ্ডুলিপিতে হাতও দিতে ইচ্ছে করেনি।
এভাবে একটা সময় দেখলাম, প্রথম পর্বের কাজ আমি শেষ করেছি প্রায় আট মাস লাগিয়ে। চরিত্রগুলো যখন তাদের রক্ত-মাংস ও উদ্দেশ্যহীনতা সম্পর্কে কিছুটা সচেতন, ক্যালেন্ডারের পাতায় নেমেছে ধুসর সেপ্টেম্বর। আজ মনে হচ্ছে, উপন্যাসটা আমি শেষ করতে পারব। প্রথম পর্ব, সেটি তো শেষ হল। এখন শুধু যা করতে হবে, উপন্যাসটিকে ছেড়ে দিতে হবে ওর নিজের হাতে।
অক্টোবর আর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ফার্স্ট ড্রাফট কি নামবে? জানিনা। স্মরণ করছি, কোলাহলে নামের ছোট্ট বইটির কথা, যা আমি লিখেছিলাম প্রথম তারুণ্যের এক হতভাগা গ্রীষ্মের অখন্ড অবসরে। তাই যদি হয়, নতুন এই উপন্যাসে আমার প্রস্তুতি প্রায় আট বছরের। তাতে কী বা আসে যায়। সারা জীবন ধরেও তো কত লেখক একটিমাত্র বই লিখতে পারেন।