আসনটা শুধুই রোনালদোর জন্য ● মাহমুদ শুকের

আসনটা শুধুই রোনালদোর জন্য

মাহমুদ শুকের ফিলিস্তিনের জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের একজন। বিশেষ করে জেরুজালেম ও এর অধিবাসীদের নিত্যকার দিনরাত্রি বুঝে উঠতে শুকেরের গল্প উপন্যাস ও নাটকের তুলনা হয় না। তার জন্ম পূর্ব জেরুজালেমের জাবাল আল-মুকবারে ১৯৪১ সালে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সত্তরেরও অধিক। লেখালেখির দায়ে একাধিকবার দখলদার ইসরায়েলি প্রশাসনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, খেটেছেন জেল। ইংরেজিতে অনুদিত তার দুটি বিখ্যাত উপন্যাস প্রেইজ ফর দি উওম্যান ইন দ্যা ফ্যামিলি এবং জেরুজালেম স্ট্যান্ড অ্যালোন। শুকের মাতৃভাষা আরবিতে লেখেন। আলোচ্য গল্পটি ফিলিস্তিনি স্কলার ও অনুবাদক ঈসা বুলাতাকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছি আমি।

এনামুল রেজা

ব্রাজিলের ফুটবলার রোনালদোকে বাড়াবাড়ি রকম পছন্দ করার ফলে তার জীবনে যে সমস্ত গুরুসঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিল কাজিম আলি ওতে পাত্তাই দিল না। সে ফুটবলের একনিষ্ঠ ভক্ত হলেও মহল্লার লোকজনের এই খেলা নিয়ে আগ্রহ ছিল না, তারা বলত, ‘দুনিয়ায় তো আর কাজের অভাব নাই যে ফুটবল দেখে সময় নষ্ট করি!’ একবার কাজিম আলির ফুটবল প্রেম চূড়ায় পৌঁছে গেলে সে ঘোষণা করল রোনালদোর সঙ্গে তার ইমেইলে যোগাযোগ হয়েছে। অচিরেই এই ভুবনবিখ্যাত ফুটবলার বউবাচ্চাসহ তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। বিষয়টাকে পাড়া-প্রতিবেশিরা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখলেও কণ্ঠে কড়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে বলে বেড়াতে লাগল, ‘রোনালোদো আসবে, এতে সন্দেহ নেই।’ 

কাজিম আলির ফুটবলপ্রীতি বিষয়ক উদ্ভট সব গল্প মহল্লায় চালু ছিল। রোলানদোর আগমন বিষয়ক ঘোষণাতেও নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করল, ‘কাজিমের কথা বাদ দাও। ওর গালগল্পের শেষ আছে?’ যদিও এইসব কথা কাজিম আলির সামনে তারা বলত না, বলত আড়ালে আবডালে। 

সে পেশায় ছিল ট্যাক্সিচালক। এক সকালে যাত্রীদের মধ্যে যারাই তার ট্যাক্সির সামনের আসনে বসতে চাইল, সবাইকে ফিরিয়ে দিল কাজিম। কারণ জানতে চাইলে সে বলল, ‘এই সিটটা শুধুই রোনালদোর জন্য।’জেরুজালেম শহরের বিবিধ প্রান্তে ট্যাক্সিটা ঘুরে বেড়াল দিনমান। কিন্তু রোনালদোকে ঐ ফাঁকা সিটে কেউ বসে থাকতে দেখেছে এমন দাবি করল না। যদিও তাকে কিছু স্বাভাবিক প্রশ্ন করা কঠিন কাজ ছিল না, লোকে তা করতও, ‘আরে মিয়া, কই তোমার ব্রাজিলের বন্ধু ফোনাল্ডো? তার বিবি-বাচ্চা কোথায়?’ (কাজিম তার প্রতিবেশীদের ভুল উচ্চারণ শুনে হাসত কিন্তু শুধরে দিত না কাউকে) এসব প্রশ্নের কোনো পরিষ্কার জবাবও সে দিত না। কেমন একটা রহস্যের ভঙ্গিতে একই কথা বারবার বলত, ‘আসনটা শুধুই রোনালদোর জন্য।’

যদিও এরপর একটা অবিশ্বাস্য গুজব ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে: ট্যাক্সির ঐ সামনের সিটে কাউকে বসতে দেয় না কাজিম কারণ আসনটা সে বরাদ্দ রাখে মেয়ে নিয়ে নষ্টামির জন্য। মহল্লার এক লোক নাকি সন্ধ্যার পর তাকে ফাঁকা ট্যাক্সিতে এক তরুণীর দিকে ঝুঁকে পড়ে কী সব করতে দেখেছে। সুতরাং কাজিম এক বেহায়া দুশ্চরিত্র ছাড়া আর কী? আচ্ছা করে বেটাকে নীতি শিক্ষা দেওয়া সময়ের দাবি।

এই গুজব স্বয়ং কাজিম আলির কানে পৌছলে সে পাগলের প্রলাপ হিসেবে বিষয়টাকে উড়িয়ে দিল। সবাই জানে নিজের বৌকে সে কত ভালোবাসে। এলাকায় তার বিয়ের কাহিনীও কি কম বিখ্যাত? সেই ভোরের কথা আজও মনে পড়ে তার। ট্যাক্সি নিয়ে সে বসে আছে। এক মেয়ে এসে বলল, ‘যাবেন?’ যাবে আর কোথায়, মেয়েটির রূপ দেখেই মাথা খারাপ হয়ে গেলো তার। বলে বসল, ‘জনাবা, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনি কি রাজি?’ পা থেকে জুতো খুলে সেই তরুণীটি কাজিমকে মারতে উদ্যত হলে ক্ষমাটমা চেয়ে পার পেয়েছিল।

কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না সে। টানা তিন দিন লাগিয়ে ঐ মেয়েটিকে খুঁজে বের করেছিল। তার আম্মা, ফুপু, আর বোনের মাধ্যমে পাঠিয়েছিল বিয়ের প্রস্তাব। ফুটবলার রোনালদো যেদিন তার স্বপ্নকন্যাকে বিয়ে করে, ঠিক এর দু’মাস পরেই কাজিমের বিয়েটা হয়। তো, সেই যে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ে, এরপর থেকে বৌয়ের সে এমনই দেওয়ানা – আর কোনো মেয়ের দিকে ফিরে তাকায় না পর্যন্ত। সেই তাকে নিয়ে এমন গুজব নিশ্চিত কোনো মন্দবুদ্ধি শয়তান লোকের কাজ হয়ে থাকবে।

যদিও এর পরিণাম এড়ানো গেল না। তিনজন মুখোশধারী লোক মহল্লার এক চিপাগলিতে নিয়ে কাজিম আলিকে আচ্ছা মত পেটালো একদিন। তারপরেও ট্যাক্সির সামনের আসনটি প্রিয় ফুটবলার রোনালদোর জন্যই বরাদ্দ রেখে দিন কাটাতে লাগল সে। এমনকি ট্যাক্সির জানালায় রোনালদোর ছবি কেটে চিপকেও দিল। এবং তার মুখে সেই এক কথা, ‘এই আসন শুধু রোনালদোর জন্যই বুঝলে না?’

কিছুদিন এভাবে কাটল। কিন্তু এবার তাকে ঘিরে যে গুজবটি রটল, তা আরও গুরুতর। জেরুজালেমে তাদের এই অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল দখলদার ইসরায়েলি সরকারের হাতে। লোকে বলাবলি করতে লাগল, মহল্লায় এক ইসরায়েলি চরের বসবাস আছে, যে গোপনে দখলদার কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য পাচার করে। কাজিম আলির গোপন আঁতাত এই চরের সঙ্গে। কেননা, কিছুদিন আগেই দখলদার সরকারের লোকজন এসে মহল্লার তিনটি বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এসব বাড়ি যে দখলদার সরকারি এজেন্সির যথাযথ অনুমতি ছাড়া বানানো, তা কর্তৃপক্ষ জানল কিভাবে? মহল্লার কোনো প্রতিবেশী কি একে অন্যের এমন ক্ষতি করতে পারে? এই গুজব আরও জোর হাওয়া পেলো যখন এক রাতে দখলদার সেনাবাহিনী মহল্লায় আচমকা হানা দিয়ে চৌদ্দজন মানুষকে ধরে নিয়ে গেলো। তারা দিবালোকের মতো পরিষ্কার বুঝতে পারল, কাজিম আলির প্রতি তাদের সন্দেহ মোটেও অমূলক নয়।

মাসখানেক আগে ‘কথা ‘কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী’ নামক একটা দল গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল মহল্লায় যার সদস্য সংখ্যা তখন পর্যন্ত ছিল সাত জন। দলটির নেতা এলাকাবাসীকে মহল্লার মূল চত্বরে ডাকলেন এক রাতে। সাকল্যে আটজন লোক আসল। যার অর্ধেকই ‘কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী’র সদস্য। নেতা হুমকির সুরে বললেন, ‘অনেক হয়েছে, আর নয়। এই বোনালদো আসলে ইসরায়েলি চর। হে বোনালদো তুমি জেনে রাখো, এই সুন্দর মহল্লায় তোমার মত বেঈমানকে আমরা বরদাশত করব না, বরদাশত করা হবে না তোমার সহযোগীকেও (এই ইঙ্গিতটা নিশ্চিতভাবেই কাজিম আলির প্রতি)।’

একদিন আরও জনাসাতেক মুখোশধারী এসে কাজিম আলিকে রাস্তায় ফেলে মারধোর করল বেধড়ক। তার বোধোদয় হলো না ওতেও। ট্যাক্সিতে তার পাশের আসনটি রোনালদোর জন্যই বরাদ্দ থেকে গেলো। অতঃপর এক বিকেলে এক লোক ক্ষিপ্ত হয়ে মহল্লার মাঝখানে এসে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘আমাদের কি যথার্থ শিক্ষা হয়নাই? এই কাজিম আলি আর কত সর্বনাশ করবে আমাদের?’ নানান বাকবিতণ্ডার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো কাজিমের পরিবারের আর সকল সদস্যদের ডাকা হবে। তারা এসে যেন এই বেয়াড়া লোককে শায়েস্তা করে।   

আর এভাবেই মহল্লার অন্য প্রান্ত থেকে হাজির হলো কাজিম আলির তেরো সদস্যের বিশাল পরিবার। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ডাকাবুকো লোকটি ছিল কসাই, ওর চাচাতো ভাই। কাজিমের গলায় ধারালো ছুরি ঠেকিয়ে সে বলল, ‘এই কোনালদো কে  বল। কে এই বদলোক?’ কাজিম বড় ভাইয়ের হাতেও মার খেলো। কিন্তু কোনো শব্দ পর্যন্ত করল না। বড় ভাই যাওয়ার আগে হুঁশিয়ার করে দিল, ‘আজ থেকে কোনালদোর নাম যেন তোর মুখে না শুনি। ঐ শালা বদমাশকে বলে দিবি, অতিসত্বর যেন সে আমাদের মহল্লা ছেড়ে পালায়। নইলে খবর আছে!’

সহ্যেরও সীমা থাকে। তাই পরিবারের সদস্যরা বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই তীব্র এক অপমানবোধে কেঁদে ফেলল কাজিম আলি। হৃদয়ের খুব গভীরে কোথাও যেন তার আঘাত লেগেছে। বৌয়ের নরম বুকে মাথা রেখে শব্দ করে সে যখন কেঁদে চলেছে, বড় ভাই মহল্লাবাসীকে তখন আশ্বস্ত করছে, ‘আর কোনো চিন্তা নেই, আগামীকাল সূর্যদয়ের আগেই এ মহল্লা ছেড়ে কোনালদো নামের আপদটি বিদায় হবে।’  

পরদিন ভোরে যথারীতি সে কাজে বের হয়েছে ট্যাক্সি নিয়ে। কিন্তু মহল্লার এক যাত্রী এসে সামনের সিটে বসতে চাইলে তাকে বাধা দিল কাজিম আলি। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই অমোঘ বাক্য, ‘এই আসনটা শুধুই রোনালদোর জন্য।’

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন