উপন্যাস কত ভাবেই না লেখা যায়, মানুষও কত ভাবেই না গল্প করতে পারে। আর ইতিহাস, তাত্ত্বিকদের হাতে পড়লে জিনিসটা কাঠ কাঠ ও পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যাওয়ার অসুখে ভোগে। অন্যদিকে সরাসরি জনগণের মুখে তৈরি যে ওরাল হিস্ট্রি, সেখানে সততার বালাই নেই, পক্ষপাতের চিন্তা পর্যন্ত নেই, নেই ইতিহাসকে বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রোপাগান্ডা করে তোলার কুটচাল – জনগণের মুখে তৈরি ইতিহাস কখনও শুধুই গল্প, এবং সরাসরি যেই জনতা নিজ অঞ্চলের ইতিহাসের কুশীলব বংশ পরম্পরায়, এই গল্প তারা মনে রাখে নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই, একেবারে নিজেদের মত করে। সেই আধা কল্পকাহিনী, আধাসত্য, আধিবাস্তব ঘটনাবলি আর জীবনের নির্মম কিংবা সুখের সব পরিবর্তনের যে গাথা, দুর্ভোগ কী সম্ভোগের দিবানিশি – একেবারে প্রান্তিক মানুষজন এসব অবলম্বন করেই বেঁচে থাকে।
ছাড়া ছাড়া নিত্য যাপনের স্কেচ, কখনও একেবারে বিচ্ছিন্ন কোনো চরিত্র (এই উপন্যাসের কোনো চরিত্র কী আসলে সংযুক্ত?), আখ্যান, স্বপ্নের ক্রয়-বিক্রয়, যুগের ও যাপনের বদলনামা, যুদ্ধ, যুদ্ধের স্মৃতি, মানুষ কেমন দেখতে, কিভাবে তারা ভাবে, কিভাবে জন্মভূমির মাটি মানুষের মনোজগতে ও শরীরে ফেলে প্রভাব, কীভাবে মানুষ প্রেমে পড়ে আর কীভাবে একে অন্যের থেকে দূরে চলে যায়? আর আমরা যারা একে অন্যকে খুব চিনি বলে দাবি করি, এই চেনার ভ্রান্তিটা কোথায়? ওলগা তোকারচুক ‘হাউজ অব ডে, হাউজ অব নাইট’ উপন্যাসে তার ছেঁড়া ছেঁড়া ছাড়া ছাড়া আখ্যানে যেন এসব বিচিত্র অনুভূতি, আখ্যান, ও টুকরো গল্পের তাজা ও শুকনো ফুল দিয়ে গেঁথে ফেলে নোয়া রুডা নামের এক শহরের মৌখিক ইতিহাস। অথবা, কিংবদন্তি।
নোয়া রুডা দক্ষিণ-পশ্চিম পোল্যান্ডের এক জনপদ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ছিল জার্মান-অধ্যুষিত। ১৯৪৫ সালের পর থেকে এই ফাঁকা ভুতুড়ে জনপদে পোল্যান্ডের নানা অঞ্চলের লোকেরা এসে বসবাস শুরু করেন। যার খুব কাছেই রয়েছে চেক সীমান্ত। স্বভাবতই, এইসব রিলোকেটেড মানুষদের গল্প নতুন দেশে মানিয়ে নেওয়ার যাদের পুরনো আবাসের স্মৃতি পরিত্যাক্ত বাড়ি ও পূর্বতন বাসিন্দাদের ভূতেরা খেয়ে নেয়।
গল্পগুলোর কোনো দৃশ্যমান কেন্দ্র নেই, একক নেই, আবার যেন এই না থাকাকে ডিফাই করে ধরা ছোঁয়া যায় না এমন একটা কেন্দ্র ও একক। পুরো বিষয়টাই এতে এমন জাদুকরী হয়ে উঠেছে যে মুগ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
নকল চুলের নির্মাতা মার্টা, প্রতিবেশী ‘কীজানিতারনাম’, চিরসুদর্শন তরুণ মারেক মারেক যার বুকে লুকিয়ে আছে বুকোওস্কির সেই নীল পাখি যে বারবার বেরিয়ে আসতে চায় আর আসেও, সন্ধ্যার সূর্যের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হয়তো মারেক মারেকের মনে পড়ে তার মায়ের কথা, আর পাখি উড়েও যায়। প্রসঙ্গত, এই লাইনটুকু তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন – ‘His mother didn’t want to breast-feeding him, as he sucked at her, she dreamed of turning into pure milk for him and flowing out herself through her own nipple..’
এদের নিয়েই এই আখ্যানের মূল চরিত্র ও তার স্বামী নোয়া রুডায় নতুন আবাসের সূচনা করে, যাদের পাথুরে বাড়ির নিচ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি নদীর ক্ষীণ ধারা।
এমন এক তরুণীর গল্প তোকারচুক তুলে আনেন, যে স্বপ্নে এমন এক লোককে দেখে যে মেয়েটিকে ভালোবাসার কথা জানায়, আর মেয়েটি স্বপ্নে দেখা সেই কবিকে খুঁজে বের করে দেখে স্বপ্নে তার প্রেমিক হলেও বাস্তবে কবি সেই মেয়েকে চেনে না। থাকে এক বৃদ্ধ জার্মানের কথা, যে নিজের জন্মভূমি দেখতে সীমান্তের ঐ পারে যায় আর একটা ছোট্ট টিলায় ওঠার পথে মরে পড়ে থাকে। সীমান্তরক্ষিরা তার মৃতদেহ দেখে ভয় পায় আর আবার তাকে সীমান্তের ঐ পারে ফেলে রেখে আসে। পুরো বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে মৃত্যুবরণ করা এক শিশুর কাহিনী, থাকে বিষাক্ত মাশরুম দিয়ে তৈরি করা নানান রেসিপির বিবরণ। আর থাকে ছুরি নির্মাতাদের অমোঘ বিশ্বাসের কথা, কেননা নোয়া রুডার পত্তনই হয়েছিল এক ছুরি নির্মাতার হাতে – ‘ছুরি নির্মাতারা বিশ্বাস করে যে, আত্মাকে এক ছুরির মতই আমাদের হৃৎপিন্ডে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ছুরিটা নড়াচড়া করলে ব্যাথায় আমাদের দেহ প্রাণ পায়, সচল হয়ে ওঠে। আত্মা নামের এই ছুরি আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে, আবার একইসাথে আমাদের খুনও করে চলেছে।’
এইরকম অসংখ্যা টুকরো কাহিনী ও বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশে আসলে নির্মিত হয় তোকারচুকের বিচিত্র সাহিত্যিক অভিযাত্রার সূচিমুখ। যা তার পরবর্তিকালের বিখ্যাত বই Flights বা Drive your plows over the bones of the dead উপন্যাসেও ছায়াপাত করেছে। ন্যারেটিভের এই অভিনবত্ব, বহুতে এককের সন্ধান, আর আঞ্চলিকতার সার্বজনিন হয়ে ওঠার আশ্চর্য ক্ষমতা হাউজ অব ডে, হাউজ অব নাইটকে করে তোলে মনোভূমি এলোমেলো করে দেওয়া এক বই। মাথায় ঝনঝন করে ওঠে এইরকম আরও অনেক লাইন – ‘They were such different people now that they might as well have changed their names – they could have filled in a form, saying: ‘we are no longer the people we used to be, so we’re applying to change our personal details,’ or something of the kind. What’s the point of population censuses, if people changing and turning into someone else? Why does an adult bear the same first name as when he was a child? Why does a once loved woman still have her husband’s surname when he’s betrayed and abandoned her? Why do men go on bearing the same name when they come back from war, or why does a boy beaten by his father keep the same idiotic name when he starts to beat his own children?’
আমি বইটা প্রায় তিন মাস লাগিয়ে পড়লাম। চাইলে হয়তো খুব দ্রুত পড়ে নেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে সে ইচ্ছে করেনি আর। মাত্র তিনশ পৃষ্ঠার ব্যাপ্তিতে এক নতুন ধরণের বিশাল জগত যে উন্মোচিত হয়েছে এই বইয়ে, তা তারিয়ে উপভোগ করতে এমন ধীর-স্থির সময় নেয়া পাঠই তো চাই পাঠক হিসেবে। তবেই না মনে হবে, স্মরণীয় সময় কাটালাম আমাদের কালের এক তুখোড় লেখকের সঙ্গে।
ওলগা তোকারচুক, সম্ভবত, গত তিন যুগে সাহিত্যে নোবেলজয়ী নারীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান কণ্ঠস্বর। এবং, সমগ্র নোবেল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা নির্বাচন। তার অবস্থানটি গুন্টার গ্রাস, মার্কেস, টনি মরিসন, ওরহান পামুকদের কাতারেই।