হোক একটা যত প্রকট ধ্বংসস্তুপ, যতক্ষণ মানুষ সেখানে বেঁচে আছে, যেভাবেই থাকুক, মানব সমাজও ততোক্ষণ শ্বাস ধরে রাখে, মরে না। মানুষের স্বভাবে আছে প্রশ্ন করা, নিজের পরিস্থিতি নিজের পরিবেশ নিয়ে মানুষ কৌতুহলি। নিজেকে সে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে পারে না বলেই অন্যদের দিকে তির্যক আঙুল তোলে।
যতই সে অসুখে দারিদ্র্যে রাজনৈতিক নিষ্পেষণে কোণঠাসা হোক না কেন, মানুষ এমনকি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও শেষ একটা সুযোগ খোঁজে, যদি বেঁচে থাকা যায়। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকা মানুষ তাই যে কোন সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারে, ফুঁসে উঠতে পারে। একটা অকল্পনীয় লড়াইয়ের বীজ তার রক্তে প্রোথিত আছে। সেই লড়াইয়ে ফলাফলের প্রত্যাশা সকলেই করে, কিন্তু আগেভাগে তা নিয়ে অধিকাংশেই ভেবে উঠতে পারে না, হয়তো চায়ও না। তাই ফলাফল সব সময় টিকে থাকার দৌড়ে যারা ধূর্ত ও শক্তিমান, যায় তাদের হাতেই। এ এক নাফুরন্ত চক্র।
আর, এসব তো আমরা জানিও। মানব সমাজ আর নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে যে লোকেই চিন্তা করেছে, সে জানে যে এ নিয়তি মানুষ প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি বয়ে চলেছে।
তাহলে সুহান রিজওয়ান ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ নামের উপন্যাসটিতে যে রাষ্ট্র ও সমাজ দেখাতে চাইলেন এর চরিত্রগুলোর চোখ দিয়ে, যে সময় ও পটভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে দিতে চাইলেন অজস্র প্রশ্ন পাঠকের দিকে, এমনকি নিজের দিকেও, সেই প্রশ্নগুলো কি উত্তর খুঁজে পেল?
গ্রীষ্মের এক মধ্যরাতে যখন আমি এ বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটা পড়ে ফেললাম, হৃদয়ে তখন খেলা করছে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ। উপরের কথাগুলো যেন আমার আঙুল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ওগুলো কীভাবে বলা যেতে পারে, কেনোই বা আমাকে এসব বলতে হবে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
ঠিক এ বইয়ের এক প্রধান চরিত্র সুহান রিয়াসাতের মতই। যে একটা উপন্যাস লিখতে চায়। কেন তাকেই উপন্যাস লিখতে হবে সে জানে না, কিন্তু জানার আগ্রহ তার অপরিসীম। কিংবা সে জানে, আর নিজের এই জ্ঞানের বিষয়ে তার অজ্ঞতা আমাদের চোখে চরিত্রটিকে আরও জীবন্ত ও কাছের করে তোলে।
একটা ডিস্টোপিয়ান জগতে ঘোরাফেরা করে গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’র চরিত্রগুলো। পারমাণবিক বিস্ফোরনে বদলে গেছে পৃথিবী। তারপর পেরিয়ে গেছে কয়েকটা প্রজন্ম। এর চরিত্রগুলো প্রায় সকলেই সেই বিস্ফোরণ পরবর্তি দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তান। তেজস্ক্রিয়তার আওতামুক্ত জীবিত বিশ্বের সাথে সুহান রিয়াসাতরা বলতে গেলে প্রায় বিচ্ছিন্ন। দেশে স্বৈরশাসন চলে। চারদিক ভরে থাকে ক্ষমতাবান শাসক ও তার চাটুকারে। দৃশ্যমান উন্নয়নের সিঁড়ি উঠতে থাকে বছরের পর বছর, যে সিঁড়ি মৃত বিশ্বের জনগণকে জীবিত বিশ্বে নিয়ে যাবে। আর দেশের ভিতরে থাকে দেয়াল। কালো সেই দেয়ালের ওপাশে কী আছে কেউ জানে না। হয়ত তেজস্ক্রিয়তায় সেখানে টিকে থাকা দায়, নইলে তা সহ্য করে তেজস্ক্রিয়তায় মিউটেটেড অতিমানবের দল সাধারণ মানুষকে মেরে কেটেই খেয়ে নেয়, ঠিক জানা যায় না। কিন্তু সরকার তার বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ বা সমালোচকের ভূমিকায় কাউকে আবিষ্কার করলেই তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেয়ালের ওপাশে। আর এই জগতে বসেই কেউ শ্রমীকদের নিয়ে আন্দোলন করতে চায়, কেউ সব রসাতলে গেল বলে আড্ডায় টেবিল চাপড়ায়, দেয়াল থেকে তেজোস্ক্রিয়তার তেজে বালুর মত ঝরে পড়ে ঘড়ি বা কোসন-বাসন, রাস্তা থেকে সকলের সামনে ঐ ঘড়ির মত উবে যাওয়ার ভয়ে লোকে ব্যবহার করে বিশেষ ধরণের স্প্রে, ওতেও অনেকের শেষরক্ষা হয় না। কেউ লেখালেখি থেকে অবসর নিয়ে নেয় কেনো না সরকারের অনুমোদন ছাড়া বই প্রকাশ নিষিদ্ধ। আর এসবের মাঝখানে থেকেই আমাদের মূল চরিত্র লিখতে চায় একটা উপন্যাস। কাকে নিয়ে? এক গ্রাফিতি শিল্পীকে নিয়ে। বদ্ধ গুমোট শহরের দেয়ালে দেয়ালে যার গোপনে আঁকা গ্রাফিতিগুলো বলতে চায় যে সে দেশে মানুষ ভালো নেই, তারা মুক্তি চায়।
গঠনের দিক দিয়ে এই বইকে প্রথমে মনে হতে পারে ফিকশন আর নন-ফিকশনের মিশ্র এক কোলাজ। কাহিনী অংশে সেই ২০৬৮/৬৯ সালের ঢাকা থেকে গল্পগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে কয়েক দশক আগে ও কয়েক দশক পরের ভবিষ্যতে। নন-ফিকশন অংশের সময়কালও একই প্যাটার্ন ফলো করে, এর ফলে যে সময়ের গল্প করা হচ্ছে বইটিতে, তা কীভাবে নির্মিত হয়েছে সে বিষয়টির গ্রাভিটি নির্মাণ হতে থাকে। অতঃপর ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি লেখক মুছে দেয়ার চেষ্টা করছেন এই দুই ধারার মধ্যিখানে থাকা সীমানাটিকে।
কিছু সমালোচনার জায়গা আছে আমার। এর চরিত্রগুলোর বহুস্বর হয়ে ওঠার চেষ্টায় একটু ভাঁটা ছিল মনে হয়েছে। গল্পাংশের অনেক থ্রেড আছে, যা আরও বিকাশের দাবি রাখে। সে দাবি পূরণ হলে নিশ্চয় চরিত্রগুলোও আরও বহুত্বের দিকে এগিয়ে যেতে পারতো। এটা বোঝা যায় যে মূল চরিত্রের দৃষ্টিসীমার বাইরে লেখক যেতে চান নাই, কিন্তু যাওয়ার সুযোগ ছিল কিনা এ প্রশ্ন আমি করে রাখলাম।
শেষ পর্যন্ত কতটা পারলেন সুহান রিজওয়ান? তার এই বইটি এক যথার্থ উপন্যাস হয়ে উঠল কী না, তা বলার আগে আমার মনে পড়ে যাবে ভি এস নাইপলের আ ওয়ে ইন দা ওয়ার্ল্ডের কথা। যেখানে লেখকের জীবনের এক পালট মুদ্রার সঙ্গে মিলেমিশে যেতে চায় ক্যারিবীয় অঞ্চলে বৃটিশ আর এস্পানিওল সাম্রাজ্যের স্বর্ণনগর খুঁজে ফেরার অভিযান আর শেষে গিয়ে বইটা আমাদের বলতে চায় যে কখনও কখনও পরাজিত মানুষকে অমরত্ব দিতে পারে শুধুমাত্র তার ঐ হেরে যাওয়ার গল্পটিই।
সব মিলিয়ে তাই মনে হয়, একে এক বিশেষ ধরণের উপন্যাসই বলবো, যেখানে কাহিনীর মাকড়শা জালে জড়িয়েও সুহান সতর্কভাবে সেই জাল থেকে বের হতে চেয়েছেন, উপায় হিসেবে সরাসরি নিজের লেখকীয় জিজ্ঞাসাগুলিকেই ছুঁড়ে দিয়েছেন পাঠকের সামনে। অমোঘ সব প্রশ্ন। যার উত্তর এই কিম্ভূত সমকালে বসে না খুঁজলে আমাদের আর চলে না।
কিন্তু, উত্তর কি লেখক নিজে কিছু আবিষ্কার করতে পারলেন? তা বইটির সম্ভাব্য পাঠকদের জন্য তোলা রইল।