লেখকের এপলিটিকাল ও গণতান্ত্রিক অবস্থান প্রসঙ্গে

লেখকের এপলিটিকাল ও গণতান্ত্রিক অবস্থান

লেখকের রাজনৈতিক দায় থাকার কথা, দরকারও, সেই দায়টা জনবিচ্ছিন্ন হলে চলে না। মানুষের অধিকারের পক্ষে লেখক কথা বলতে পারেন। মূলত, লেখক তা বলেনও, তিনি নিজেও যেহেতু জনগণের অংশ – নিজের অধিকারের কথা বললেও সেইটা জনগণের পক্ষের কথাই হয়। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লেখকের অবস্থানটা খুব বেশি ঘোলাটে হওয়ার সুযোগ আছে কিনা এ নিয়ে আমি অনেক কে প্রশ্ন করেছি। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মূল দুটি যে রাজনৈতিক ধারা, লেখক এ দুটির কাছে নিজের চিন্তা বর্গা দিতে বাধ্য কিনা, এটাই আমার দীর্ঘদিনের জিজ্ঞাসাবিন্দু।

এ বিষয়ে আমার সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতা আজকের লেখায় শেয়ার করব। ভাড়ার বাইকে চড়ে মোহাম্মদপুর থেকে আমার কর্মস্থল মিরপুর ডিওএইচএস যাচ্ছিলাম। বাইকার লোকটি কথায় কথায় বলছিলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে ঢাকায় কয়েক দিন ধরে জ্যাম খুব বেশি। কী জিনিস বানাইছে ভাই। আর এইসব জিনিস তো টিকবেও না। দশ বছরের মধ্যেই দেখবেন ঘাপলা হইছে।’

সরকারের উন্নয়ন মডেলের ফাঁকি, রিজার্ভ সংকট, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক উর্ধ্বগতি – সব কিছু নিয়েই লোকটির মন্তব্য আছে। এইসব থেকে আমরা ইলেকশনের আলাপেও চলে আসি। জিজ্ঞেস করি, ‘ইলেকশনে বিএনপি জিতবে?’

‘আওয়ামী লীগ কি আর ইলেকশন করতে দিবো? যুদি সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়, জনগণ জিতাইয়া আনবে বিএনপিরে।’

‘কিন্তু ইলেকশনের এই দাবি বিএনপি তো সেইভাবে জানাতে পারছে না। তাদের আন্দোলন কোথায়?’

‘আন্দোলন তো ভাই অন্য লেভেলে চলতেয়াছে। বিএনপির পক্ষে আছে আমেরিকা। আন্তর্জাতিক সাপোর্ট আছে। এই আন্দোলন অন্য লেভেলের।’

তারপর লোকটি বলে জিয়াউর রহমানের কথা, ‘জিয়াউর রহমান আছিলেন সেই লেভেলের অনেস্ট লোক। তার কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি আছিলো না। এক্কেরে সিম্পল জীবন যাপন করতেন। হের পোলাপান ছোডোকালে কি কষ্টই না করসে। কিন্তু দেখেন, আজকে তার পোলা তারেক সাব লন্ডনে যেই বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়ির ভাড়া মাসে পাঁচ কোটি টেকা। বাপে এতো গরিব আছিলো, আল্লা কী সম্মানডা দেছে তারে ভাই দেখেন।’

‘তাহলে বলেন তো ভাই, জিয়াউর রহমান এতো অনেস্ট লোক, সহজ সাধারণ লাইফ লিড করতেন, তার ছেলে হয়ে উনি পাঁচ কোটি টাকার বাড়িতে থাকার বিলাস কেমনে করেন? উনি তাইলে তো আর বাপের মত হলেন না। ওনার আয়ের উৎসেরও তো ঠিক নাই, নাকি আছে?’

বাইক চালক আমার উত্তরে হতাশ হয়ে চুপ করে যান। আমি তাকে বলি যে, ‘ইলেকশনে বিএনপি জিতে আসলে কি জনগণের জীবনে কোনো উন্নতি আসবে? বিএনপির সরকার গঠনের রূপরেখা কী? সেইসব কি ওনারা বলেন?’

আমি আরও বলি যে, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার ফলাফল তো আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি গত পনেরো বছর ধরে। বিএনপি আসলেও তারা জনগণের জন্য কী পরিবর্তন আনতে পারবে, এটি নিয়ে কোন পরিষ্কার বক্তব্য নেই, কিন্তু ক্ষমতায় যে কোনো মূল্যে আসতে চায়। অর্থাৎ তাদের রাজনীতিও ক্ষমতায় আসার রাজনীতি, জনগণের পক্ষের কোনো ঘটনা নয়। ইলেকশনে জিতে যদি বিএনপি আসেও, সর্বোচ্চ উপকৃত হবে দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত লোকজন, সাধারণ জনতার জীবন যেমন ছিল, তেমনই থেকে যাবে, তাই না?’

বাইক ততোক্ষণে গন্তব্যে চলে এসেছে। হেলমেট খুলতেই দেখি একটা হাসিমুখ, ‘আমগ আর কী মামা। এইডা তো সত্যই, আমগ লাইফের কোনো বদল আইব না।’

এই শেষের আলাপটি জনগণের সঙ্গে খুবই সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ইতিহাস যতো না গণমুখী, তারচেয়ে বেশি পরিবারতন্ত্র ও এলিটমুখী। স্বাধীন বাংলাদেশে মাঠ পর্যায় থেকে নেতা হয়ে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, এমন অবস্থা তৈরি হয়নি। এমনকি তৈরি হয়নি বিকল্প নেতৃত্বের ধারাও। যখনই যে দল ক্ষমতায় এসেছে, অধিকাংশ সময়েই আমরা দেখেছি কীভাবে মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গেছে, বারবার।

পাশাপাশি আমরা এটাও দেখেছি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিয়ে আম জনতার যত কাইজা ফ্যাসাদ, সমাজের ক্ষমতাবান ও অর্থনৈতিক একটা লেভেল পার করে আসা মানুষেরা এসবের কত উর্ধ্বে বসবাস করেন। তাদের সান্ধ্যউৎসব ও বৈদেশিক অবসরে একই পরিবারের দুই সদস্য দেখা যায় বিএনপি আওয়ামী লীগের তুমল নেতা, সংসদ সদস্য ইত্যাদি। বাংলাদেশে এমন অনেক রাজনৈতিক পরিবারও আছে, যারা সব সময়েই ক্ষমতাবান দলের পারপাস সার্ভ করে থাকেন। বিএনপির আমলে হোক বা আওয়ামী লীগের আমলেও।

তো, এইসব আলাপের মাঝখানে লেখক যখন আবিষ্কার করেন, দলীয় রাজনীতির পুরো বিষয়টিই আসলে ক্ষমতামূখী, জনবিচ্ছিন্ন, এবং এসব দলের আন্দোলনে সাধারণ জনগণের অবস্থান স্রেফ ‘ব্যবহার হওয়া’ পর্যন্ত, সেখানে তিনি কী করবেন? সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ত এপলিটিকাল হয়ে ওঠা। অর্থাৎ, ক্ষমতায় কে আসল গেলো এ নিয়ে চিন্তা না করা বা একে গুরুত্ব না দেওয়া।

কিন্তু, জনগণের পক্ষে কথা বলতে হলে ডেফিনিটিভ এপলিটিকাল হওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। আর তখনই আমরা বুঝতে পারি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পলিটিকাল ইভেন্টগুলোর জনসম্পৃক্ততা নিয়ে লেখকদের সব সময়েই সচেতন থাকা কতটা জরুরি। ক্ষমতাবানের জন্য প্রশ্ন ও সমালোচনা থাকা জরুরি। কেউই অবিসংবাদিত নয়, সেটা হওয়া সম্ভবও না। লেখকের কাজ সম্ভবত, জনগণের হয়ে ক্ষমতার দিকে এই প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দেওয়া।

ভোটের অধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রশ্নে যারা শুধু বিএনপিকেই ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন, তাদের জন্য প্রশ্ন – বিএনপি সরকার গঠনের রূপরেখা এখন পর্যন্ত জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পেরেছে কি? তাদের সমস্ত রাজনৈতিক এক্টিভিটি শুধুই ক্ষমতায় যাওয়ার অভিলাষ নিয়ে, এই অভিযোগের বিপরীতেই বা তাদের বক্তব্য কী?

আওয়ামী লীগ টানা তিন দফা ক্ষমতায় আছে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে জনগণের ভোটে হেরে যাবে বলে একটা প্রচলিত ন্যারেটিভ আছে। আওয়ামী লীগের কাজ হলো এই ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ করা। খালি চোখে আত্মঘাতী মনে হলেও দলটির ভবিষ্যতের জন্য সম্ভবত এটাই সবচেয়ে দরকারি মুভ। এবং, আমি মনে করি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগই সবচেয়ে বেশি সংযুক্ত রাজনৈতিক দল। ঠিক এ কারণেই জনতার আস্থার এসিড টেস্টে তাদের নামতে হবে।

দুর্দিন বা সুদিন, যাই আসুক, তা বেছে নেওয়ার অধিকার জনতা ফিরে পাক। এবং জনগণের এই অধিকারের পক্ষে থাকাই সম্ভবত এখন লেখকের গণতান্ত্রিক অবস্থান নিশ্চিত করে।

2 Comments

  1. আমার মতে লেখক হলো নৈরাজ্যভিত্তিক নৈরাজনৈতিক মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্র-পররাষ্ট্র কিংবা প্রধানমন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রীও হতে পারে। রাজনৈতিক দল-মাদল, অভিজাত হংসপক্ষী, অ বা অরীয় রাজনৈতিকতা ব্যাপারগুলো নিয়ে সহজ সুন্দর আলাপ, রেজা।

    উড়াল-Moral : চলতিপথে চালকদেরকে এতো ত্যক্ত করিস না। 😛

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন