গত তিন মাস ধরে গোলাপের নাম পড়তে পড়তে বেশ অনেকগুলো টুকরো মন্তব্য করেছি নানান জায়গায়। সেসব জোড়াতালি দিলেও হয়ত কিছু একটা দাঁড়ায়, কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না মনে হয়।
বইটা আমি গত রাতে শেষ করেছি। ভোরের দিকে চুপচাপ বসেছিলাম অনেকক্ষণ। কী পড়লাম এটা ভেবে!
মধ্যযুগের খৃষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব, যাযকতন্ত্র, রোমের পোপ ও সম্রাটের দ্বন্দ্বের পাশাপাশি চার্চের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ, ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ করার অনেক রকম সুতো আছে। কিন্তু একো বেছে নিয়েছেন সম্ভবত, সবচেয়ে কৌতূহল জাগানিয়া সুতোটিই – যিশু কি ধর্মপ্রচারকদের দরিদ্র থাকার নির্দেশ দিয়েছেন নাকি ধনসম্পদ জমিয়ে ধনী হয়ে ওঠা চার্চ ও অর্থলোলুপ পোপের রাস্তা ঠিকঠাকই আছে?
এই তর্ক কেবল সুতোই। এবং কখনও কখনও মনে হবে (অধিকাংশ সময়) মূল গল্পের সঙ্গে এগুলোর কোনো সংযোগ নেই।
উপন্যাসের মূল চরিত্র বাস্কারভিলের উইলিয়াম আর তার শিষ্য মেলকের আদস ঐ তর্কের নিরসনে পুরনো ঐতিহ্যবাহী এক ইতালিয়ান মঠে হাজির হয় সম্রাটের পক্ষ থেকে – সম্রাট, যিনি কিনা চার্চের ধনসম্পত্তি ও ক্ষমতার বিরোধীদল, অন্যদিকে এই একই মঠকে মিডলগ্রাউন্ড ধরে নিয়ে পোপের পক্ষের লোকেরাও আসবে তর্কে যোগ দিতে, যার আভাস শুরু থেকেই পাওয়া যায়।
উইলিয়াম আর আদস মঠে আসার আগের রাত থেকেই মূলত হত্যাকাণ্ড (মঠের এক ব্রাদার আদেলমোকে দিয়ে যার সূচনা) শুরু হয়। এবং উইলিয়াম মঠাধ্যক্ষের অনুরোধে এই হত্যাকান্ডের তদন্তের ভার নেন।
বইয়ের কাহিনী এগিয়ে চলে মঠে পরবর্তি সাতটি দিন আর প্রতিদিন একটি করে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি রহস্যের কিনারার দিকে উইলিয়াম ও আদসর এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, মধ্যযুগীয় ক্রিশ্চানিটি নিয়ে বিরাট কচকচি – কখনও কখনও যা ক্লান্তিকর আবার মজাদারও, ফ্রান্সিস্কান ও বেনেডিকটিয়ানদের দ্বন্দ্ব, এবং এই বইয়ের দুটি মূল মোটিফ – বিরুদ্ধমতের প্রতি তৎকালীন চার্চের অবস্থান ও জ্ঞানকে মানুষের নাগালের বাইরে রাখতে ক্ষমতার দুরন্ত অপচেষ্টা।
আমার ধারণা, চিহ্ন বিজ্ঞান এবং তদন্ত প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কৌশলগুলো এ বইয়ের সবচেয়ে চটকদার দিক, যা মূল বিষয়বস্তুর উপরে বেশ রহস্যের এক পর্দা চড়িয়ে রাখে একেবারে শেষ পর্যন্ত। এতসব রূপক, ভ্রম আর ধাঁধাঁ আছে যে পাঠক কখনও কখনও খেই হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু যা চটকদার নয়, গভীর ও বিষণ্ণতায় মোড়া তা এ বইয়ের পুর্বোল্লিখিত দুটি প্রধান মোটিফই।
এই বইয়ে আলোচিত হয়েছে দলচিনিয়দের সঙ্গে চার্চকেন্দ্রিক ধর্মগুরুদের দ্বন্দ্বের কথা – কেমন নৃশংসভাবে চার্চ এদের দমন করেছিল, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। অতীতের সেই ঘটনার সঙ্গে উপন্যাসে চলমান কিছু ঘটনার প্যারালাল সৃষ্টি করেছেন একো, যা শুধু ভয়ানকই নয়, বার্নার্দের গুই নামের লোকটা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের ইতিহাসেরই এক অন্যতম কানিং চরিত্র।
অন্যদিকে যেই আলোচ্য মঠ এই কাহিনীর কেন্দ্র, সেখানের যে গ্রন্থাগার যাতে প্রবেশ অধিকার নেই এমনকি মঠের ব্রাদারদেরও – সেই গোপনীয়তার উৎসও উঠে আসে অতীতের নানান চোরাগোপ্তা পথ বেয়ে। এডিফিকিউম বা লাইব্রেরি ভবনটা নিশ্চিতভাবেই মনে করিয়ে দেয় বোর্হেসের লাইব্রেরি অব বাবেলের কথা। যেই গ্রন্থাগারকে বোর্হেস বলেছেন অনিঃশেষ এবং পৃথিবীর রূপক। কিন্তু একোর এই লাইব্রেরির পরিণতি পাঠককে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে ছাড়ে।
মনে পড়ে যায় সেই চিরায়ত ধর্মতাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কথা – শয়তান প্রশ্ন করেছিল তাই সে অভিশপ্ত, আর আদম নিষেধ মানেনাই তাই তার স্বর্গ থেকে পতন। দুটি ঘটনাই আমাদের জ্ঞানের তৃষ্ণাকে নির্দেশ করে। জানতে চাওয়া অপরাধ, প্রশ্ন করা অপরাধ। এবং ক্ষমতা যাদের হাতে, তাদের কাজ হচ্ছে মানুষকে জানতে না দেওয়া, জ্ঞানের উৎসগুলো কব্জা করে রাখা।
আরও মনে পড়ে আদসকে বলা উইলিয়ামের অমোঘ কিছু কথা।
‘আর যারা সত্যের জন্য মরতে প্রস্তুত, তাদের ভয় কোরো আদস, কারণ নিজেদের সঙ্গে তারা সম্ভবত অন্যদেরও মরার ব্যবস্থা করেন, প্রায় ক্ষেত্রে নিজেদের আগেই, মাঝে মাঝে তাদের নিজেদের বদলে।’
‘যারা মানবজাতিকে ভালোবাসেন, তাদের ব্রত হলো মানুষকে ভাবতে বাধ্য করা যাতে তারা সত্যকে উপহাস করে, তাদের ব্রত হওয়া উচিত সত্যকে হাসানো, কারণ, সত্যের জন্য এক উন্মত্ত সংরাগ বা সুতীব্র আবেগ থেকে আমাদেরকে মুক্ত করতে শেখার মধ্যেই একমাত্র সত্যটি নিহিত রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, এই লেখায় যোগ করে দিচ্ছি আমার পুরনো একটা মন্তব্য, বিদ্রূপ ও ঠাট্টার গুরুত্ব কত গভীর – জ্ঞানের যাত্রায় ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামে এ কত বড় অস্ত্র এটা, তা নিচের অংশ থেকে বোঝা যায়।
ইয়র্গে নামের প্রায় সর্বদর্শী এক বৃদ্ধ ও অন্ধ সন্ন্যাসীর সাথে বাস্কারভিলের উইলিয়ামের হাসি বিষয়ক তর্কের একটা জায়গা আছে।
যেইখানে সর্বদর্শী ও মঠের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিরক্ত ইয়র্গে হাসির বিপক্ষে নানান বইপত্র থেকে যুক্তি ও রেফারেন্স দিতে থাকেন। তার মতে, ঈশ্বরের সাধকদের হাসা উচিত না, হাস্য করা শয়তানের কাজ, এমনকি বুদ্ধিমান লোকদেরও উচিত হাসি বর্জন করে সারাদিন মুখ গোমড়া করে থাকা।
উইলিয়ামকে এই তর্কে দেখা যায় তার স্বভাবসুলভ উইট বজায় রাখতে। এবং রেফারেন্স ব্যবহারে সেও কম যায় না। কিন্তু ইয়র্গে সব কথার শেষে থাকে অনড়, তার শেষ কথা হলো – ‘যিশু কখনও হাসেন নাই।’
যিশু যে কখনও হাসেন নাই, এইটা তো কেউ দেখেনাই। কিন্তু ইয়র্গের বিশ্বাস যিশুর মত একজন মহান বিবেচক হাস্যর মত একটা কাজ করতে পারে তা সম্ভবই না।
তর্কের এক পর্যায়ে উইলিয়াম একটা গল্প করেন। যেই গল্পে গাধার চরিত্রটি প্রায় এপুলিয়াসের স্বর্ণগাধার মতই। লাতিনে রচিত প্রাচীন এই উপকথায় গাধার চরিত্র দিয়ে চার্চ ও সর্বস্তরের মানুষের বিবিধ অনাচার ও মূঢ়তাকে নৈতিক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে তুলে ধরাই এই কাহিনীর উদ্দেশ্য। তো এমন এক গম্ভীর বইয়েও একটা অংশ আছে, যেখানে এক মঠে থাকাকালীন সময়ে গাধা ভাবতে থাকে যে, রাতে বাতাসে যদি কম্বল উঠে যায়, তাহলে তো সন্ন্যাসীরা একে অন্যের পুরুষাঙ্গ দেখে ফেলবে, কী একটা হুজ্জত হবে নিজেরা নিজেদের ঐ জিনিস দেখে ফেললে।
এই বর্ণনা শুনে মঠের অন্যান্য সন্ন্যাসীরা হাসতে থাকলে ইয়র্গে রেগে গিয়ে বলেন, উইলিয়াম তোমার মুখের কথা তো পাদের মত।
এর প্রতিবাদ করার বদলে তর্কের এই জায়গাটায় বাস্কারভিলের উইলিয়াম স্বেচ্ছায় মুড সুইং করে। অর্থাৎ সে বিনয়ে গলে গিয়ে ইয়র্গের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় আর বলে, ইয়র্গে ঠিক সে নিজেই ভুল, ইত্যাদি।
এই দৃশ্যটা একই সাথে যেমন উইলিয়ামের তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে পাঠককে একটা ধারণা দেয়, যে তার জেরা করার পন্থাই আলাদা, সাথে সাথে একো যে এক রকমের ঠাট্টা করছেন স্ক্রিপচার ও পুরনো ধর্মীয় বিধিমালার উদ্ভট কথাবার্তাগুলো নিয়ে, সেটা ধরতে পারা যায়।
পরিশেষে বলি, রহস্য কাহিনীর মোড়কে গোলাপের নামকে পৃথিবীর সেইসব বিরলতম লিটারারি ফিকশনগুলোর একটাই মনে হলো যা নিয়ে মানুষের আগ্রহ কখনও কমবে না। বিশেষ করে, বই জ্ঞান বিশ্বাস ও সন্দেহের তর্ক, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের পেছনে ধর্ম ও সাধারণ মানুষের লড়াই, আর স্মৃতি – সব মিলিয়ে এমন কাজের সাথে তুলনা দেওয়ার মত কিছু থাকলে বোর্হেসের গল্পগুলোই কেবল থাকতে পারে। দুর্ধর্ষ। যেইখানে তর্ক হতে পারে কে বেশি জ্ঞানী লোক, বোর্হেস নাকি তার শিষ্য একো। একো বরং বেশি মানবিক, বেশি কাছাকাছি। বোর্হেস উপন্যাস লিখলে হয়ত গোলাপের নামই লিখতেন।
বলতে হয় এ বইয়ের অনুবাদ প্রসঙ্গে। না বললে আসলে চলে না। জিএইচ হাবীব অসাধ্য সাধন করেছেন। মূল বইটিকে দাবি করা হচ্ছে মধ্যযুগের এক পাণ্ডুলিপি হিসেবে। বাংলায় অনুবাদের সময় জিএইচ হাবীব সেই পুরনো গম্ভীর আবহ ধরে রাখতেই হয়ত এমন ভঙ্গী গ্রহণ করেছেন। যে প্রচেষ্টাকে প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই করা যায় না। এমন এক কর্মযজ্ঞের বাংলা অনুবাদের জন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তাকে অভিবাদন জানাই।
আর কী? তাহলে শেষ পর্যন্ত কী টিকে থাকে এই পৃথিবীতে? কী থাকে, নামই তো, আর কিছু নয় – stat rosa pristina nomine, nomina nuda tenemus.