
ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে বাংলা গল্পের চর্চা হচ্ছে অনেকদিন। এসব গল্পে বরাবর একটা কমন প্যাটার্ন থাকে। তবে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল শুরুর লাইন। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, চিত্তাকর্ষক এসব লাইনের একটা তালিকা করি।
১। বাসর রাতে নিলুফাকে তার জামাই বললো এই গরমে এত মোটা শাড়ি কেন পরেছ?
২। মিতু বিরক্ত হয়ে বাছেদকে বললো, বারবার গায়ে হাত দেবেন না তো!
৩। সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে আমার শরীর তখন সম্পূর্ণ অনাবৃত কাপড় বিহীন।
৪। চড় মেরে পাঁচ আঙুল বসিয়ে দিলাম তিথির গালে।
৫। বিয়ের বাজারে আমার চাহিদা তরতর করে শূন্যের কোঠায় নেমে এলো কারণ আমি ধর্ষিতা।
৭। আমার দাদীর বিয়ে হয় ৭ বছর বয়সে।
৮। দিনের পর দিন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো শারীরিক আনন্দের বস্তু হতে কেমন লাগে সেটা একমাত্র সেই মানুষটাই জানে।
৯। একটু আগে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে আসল।
১০। ছেলেদের টেস্টিজ কয়টা? প্রশ্নটা শুনেই আমার মুখটা মরা ঝিনুকের মতো হা হয়ে গেল।
উপরের প্রতিটি লাইনই পাঠক টেনেছে। সবচেয়ে কম পাঠকপ্রিয় গল্পেরও আছে নিদেনপক্ষে ছয়শ রিএকশন আর পঞ্চাশটি মন্তব্য। জনপ্রিয় গল্প লিখতে চাইলে অবশ্যই এ সাফল্যসূত্র ব্যবহার করতে পারেন। গল্প যেমনই হোক, পাঠক পাবেন।
ন্যাড়া একবারই বেল তলায় যায়। তবে পরেরবার দাঁড়ায় নারিকেল গাছের নিচে।
অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ জনগণ হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চললে সরকার হয়ত ছুটি বাড়াত। সেটা যখন হয়নি, স্বাভাবিক ঈদও উদযাপিত হল, প্রশাসনের কাছে আসলে আর কোন যুক্তি নেই অর্থনৈতিক বার্ডেন বাড়িয়ে তোলার। যদিও ক’দিন পর এই অবুঝ জনগণই ‘আবার কেন লক-ডাউন দিচ্ছেনা’ শীর্ষক কান্নাকাটি করবে – এরকম আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
ঈদে গ্রামে যাওয়া হলনা এ বছর। আমার আনন্দ ছিল ঐ আব্বা-আম্মা, বোনদের সঙ্গে সময় কাটানোতে। আর কবেই বা তা হবে জানিনা।
নন-স্মোকারদের নিয়ে অনেকের ধারণা এমন যে, সিগারেট খায়না, এর মানে দীর্ঘ জীবন চায়, বেশিদিন বাঁচার খায়েশ ইত্যাদি। এই ধারণায় ভুল আছে মনে হয়। নিজেকে দিয়েই বলি।
আমি স্মোক করিনা কারণ জিনিসটা আমার ভাল লাগেনা। গাল কষটা হয়ে যায়, মাথা ধরে। তবে কোন দিন মনে খুব আনন্দ যদি লাগে, বন্ধুরা আয়েশ করে ধরিয়েছে সিগারেট, আমিও একটা ধরালাম, এরকম হয়।
সুতরাং বছরে দুই তিনটা সিগারেট আমি খাই। এমন না যে স্মোকার হবার চেষ্টা করিনি কখনও। কিন্তু নিকোটিন আর আমার মধ্যে সম্পর্কের কোন উন্নতি ঘটেনাই। তো, যে কারণে কথাগুলো বলা, স্মোকাররা যেমন কোন কিছু না ভেবেই স্মোকিং শুরু করেছিল জীবনে কোন একদিন, নন-স্মোকাররাও এমনই। কিছুই আলাদা করে তারা ভাবেনা। সিগারেট না খেলে কী কী লাভ, এই বাণীগুলো একান্তই স্মোকারদের চিন্তা মাথায় রেখে বলা হয়।
তবে হ্যাঁ, ডাক্তার কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, এর ফলে বহু মানুষকে দেখেছি সিগারেট ছেড়ে দিতে। এমনকি এই লক ডাউনের সময় দুই মাস সিগারেট না খেয়ে কাটিয়ে দিতে দেখলাম আমার মামাকে। অথচ সারাজীবন ধরে বাড়ির মুরব্বিরা হাজার বলে কয়েও নিকোটিন থেকে তারে পারেনাই সরাইতে দূরে।
যাই হোক, সুখের বিষয় আমার সব স্মোকার বন্ধুরা সাপ্লাই নিয়ে দারুণ ঝামেলায় পড়েছে কোভিড দুর্যোগে। তার উপর নাকি জিনিসটার উপর সরকারি ফাঁড়া আসছে। বন্ধুদের প্রতি অগাধ ভালবাসার কারণেই পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে আমার।
ধরেন একটা ক্রাইম হল। তদন্তের আগেই যদি মিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট মানুষেরা ক্রিমিনাল ঠিক করে ফেলে, বুঝবেন যে ঘাপলা আছে। রণেশ ঠাকুর বাউলের গানের ঘর দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটা অংশ বাউলদের ধর্মশত্রু মনে করে, দুই-এ দুই-এ চার মিলিয়ে অনেককে দেখলাম কালপ্রিট কারা তা ঘোষণা দিয়েছেন, কিছু পত্রিকা জানিয়েছে তাদের অনুমান। হিসেব এত সহজ নাও হতে পারে। বিশেষত, সোশাল আনরেস্ট তৈরি হলে কারা বেশি লাভবান হয়, এটা মাথায় রাখবেন সব সময়।
একজন বললো, “পাশশ টেকা টিকিট, দশ হাজার টেকা দিয়া কাইটা হইলেও গেরামে ঈদ কঅরবো।” এর পরে তো আর কথা থাকেনা গোলাম হোসেন। বাঙালকে শপিং ঈদ বরাবর ধুমধামের সঙে করতে দিতে হবে। আর আক্রান্ত হলে প্রশাসন ও ডাক্তারদের গালি দিতে হবে।
না পড়ে কোন লেখকের সমালোচনাকে হাফউইটের লক্ষণ বলে অনুমান করি। কারও লেখা আপনার কাছে পৌছায়নাই, এটা লেখকের সমস্যা কোন ভাবেই না। আপনি নিজেকে চাইলে অযোগ্য পাঠক ভাবতে পারেন, নাও পারেন।
তার সময় অসময়ের বৃত্তান্ত আমার বুকশেলফে বাঘ হয়ে ছিল অনেকদিন। সামনে দিয়ে গেলেই একটা হুংকার ছাড়ত। কেমন কর্মযোগ আর ধ্যানে অমন পর্বতপ্রমাণ সব মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখেছেন। বাংলাভাষী সাধারণ পাঠক নিশ্চয় এক সময় তাকে পড়ে নেয়ার মত যোগ্য হয়ে উঠবে। দেবেশ রায়ের জন্য ভালবাসা।
আনিসুজ্জামান ছিলেন সেই প্রবীণ বটের মতন, দূর থেকে দেখলেও স্বস্তি লাগত, ভাল লাগত। এদেশের নামের সঙ্গে তার নামটি জড়িয়ে রইল। তার মত এমন আর কাকে পাব আমরা যিনি হবেন শত্রু মিত্র সবার।
বই বলতে সব সময়েই কাগজের বইকে বুঝি আমি। কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ই-বুক একটা দারুণ অপশন। পকেটে কয়েক’শ বই নিয়ে ঘুরছি, যখন তখন দু’পাতা পড়ে নেয়া যাচ্ছে, ব্যাপারটা মন্দ না।
আমাদের দেশে ই-বুকের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা প্রায় নেই। তবে করে তোলা যায়। তুলতে হবেও। একটা আইডিয়া এমন হতে পারে, একজন পাঠক যে ডিভাইস থেকে ই-বুকটা কিনবেন, সেটা ছাড়া আর কোন ডিভাইসে ফাইলটা ওপেন করা যাবেনা। ঠিক পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড এমন নয়, বরং বইটা সেল হবে ডিভাইস ওরিয়েন্টেড রেস্ট্রিকশনের ভিত্তিতে। কেউ চাইলে বাড়তি পেমেন্টের মাধ্যমে ডিভাইস লিমিট বাড়াতে পারবেন।
ই-বুকের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি সম্ভবত এভেলেবল না। তবু চিন্তাটা টুকে রাখলাম। কেউ না কেউ এভেলেবল করে ফেলবেন।
আমাদের মার দিতেন আম্মা। ভারি কিছু না। একটা নির্ধারিত সীমা রেখে, হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে। কিন্তু ওতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতাম। এবং দেখা গেছে কয়েকদিন পর আবার কিছু একটা বিচিত্র সাধন করেছি। পরিণাম অভিন্ন। এই জীবনে আম্মাকে কম জ্বালাইনাই। শৈশবে নিজে খুব ডানপিটে ছিলেন, তার কিছু অংশ প্রথম সন্তান হিসেবে আমি পেয়েছিলাম। এগুলো যে এমন মধুর গল্প হয়ে জমা পড়বে স্মৃতির বাগানে, জানলে হয়ত দুষ্টামি বাড়িয়ে করতাম আরও। বড় হয়ে উঠবার একটা বয়স এমন গেছে, আম্মা ততোদিনে আমাকে আর বকা দিচ্ছেন না, মার তো দূর। ঐ বয়সটায় একেকদিন মনে হত, “কী আজব, রাগ করছেনা কেন? দুষ্কর্ম কি পর্যাপ্ত হয়ে উঠছেনা আজকাল?”
সব ধরনের ঘটনায় কেবল দুই ধরনের মানুষই বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে থাকেন। একদল, যারা বিষয়টা একেবারেই বোঝেন না। আরেকদল, যারা বিষয়টা নিয়ে কিছুই বোঝেন না।
দার্শনিক, চিন্তাবিদ, লেখক, চিত্রকর – এঁরা মানব সমাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন। এবং সমাধানের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেন। মানে এঁরা হলেন প্রভাবক। সমস্যা সমাধান করার কাজটা সকল মানুষের।
অনেক বই আছে যেগুলো ঠিক বয়সে পড়লে আমার জীবন অন্যরকম হতে পারত। যেমন হাকলবেরি ফিন। ক্লাস সিক্স-সেভেনে এই বইটার মূল ভার্শন পড়ার সুযোগ হলে আমি হয়ত অনেক বারই ঘর থেকে পালাতাম।
আপনার প্রশংসা ইডিয়টের মত হলে যারই প্রশংসা করবেন, সে বিপদে পড়বে। যেমন বিদ্যানন্দের প্রশংসা করতে গিয়ে অনেককে বলতে শুনেছি – সরকার যা পারছেনা, বিদ্যানন্দ তা পারছে।
করোনাকে বিগত মাঝরাতে গ্রেফতার করেছে রেব। ফেসবুকে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ।
আল্লাহ যে বাঙালি মোছলমানকে এই সনাতন বঙ্গে এনে ফেললেন, জবানে দিলেন হিন্দুয়ানী বাংলা ভাষা, আল্লাহর সেই সিদ্ধান্তের প্রতি বাংলার মোছলমানেরা বেজার। বারবার এটাই তারা প্রমাণ করে।
গত এক মাসে বার তিনেকের মত জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছি। মানুষের অখণ্ড অবসরের গান শুনেছি।
যদিও আমার কাছে উইকেন্ডের মানে এখনও আগের মতই আছে।
বাসায় বসে অফিস করছি। ব্যস্ত সময় কাটছে। কিন্তু মানসিক চাপ, মৃত্যুর সংবাদ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়া, অবসন্নতা, গৃহবন্দীত্ব – এইসবে আর সবার মতই আক্রান্ত হয়ে চলেছি নিত্যদিন।
অনেক সময় মনে হয়েছে, আমি চিকিৎসক নই, প্রশাসনিক কেউ নই – এই দুর্দিনে মানুষের জন্য কিছুই আমার করার নেই। যেহেতু আমি লেখক, শব্দ আমার অস্ত্র, তাহলে মানুষের কাজে লাগে, এমন কিছু কেন আমি লিখিনা?
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে মানুষকে আমি জানাতে পারি, বাংলাদেশ ঠিক কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এখন – এটাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি। এমনকি মানুষ আনন্দ পাবে, এ ধরণের ফানি আইডিয়াও এসেছে মগজে।
প্রত্যেকটা কাজেই শেষ পর্যন্ত আমার কী-বোর্ড থেমে গেছে। কিছুই হয়ে ওঠেনি।
শুধু দেখলাম আমি অনেকগুলো ছোট আকারের গল্প লিখেছি। এগিয়ে নিয়ে গেছি দীর্ঘদিন ধরে লিখতে থাকা উপন্যাসটা। পড়ছি প্রচুর।
হিসেব করে দেখলাম, মহামারির ডিফেন্সে এগুলোই আমার কাজ।
মনে হয়েছে, সময়ের যে কোন বড় চিন্তক তার একটা ঝটিকা লেখায় সমাজের কোন পরিবর্তন আনতে পারেন না। যখন সবাই ভয়ে চিৎকার করছে, তখন একজনের বা দশজনের কাজের কথাও আর শুনতে পাওয়া যায় না আলাদা করে।
এ ধরণের পরিস্থিতিতে কাল্ট তৈরি হয়। সমচিন্তার মানুষেরা যার যার নিজেদের মত দল গঠন করেন।
এই সমস্ত ছোট ছোট দল দুর্যোগের মধ্যে নিজেদের চিন্তা পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সার্ভাইব করার চেষ্টা করেন। যা এখন আমাদের অনেকেই করছেন।
লাইভে এসে, তথ্যচিত্র বানিয়ে, লিখে বা শুধুই একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করে। যে যেভাবে পারছেন।
লং রানে এইসব চিন্তাধারা ভবিষ্যতের মানুষকে নতুন কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রভাবিত করতে থাকবে।
যেমন, এই ছোট্ট লেখাটা লিখতে গিয়ে মনে হল, যুদ্ধের দিনে একজন অসহায় মানুষ শুধু পেটে-ভাতে টিকে থাকতে যে সংগ্রাম করেছে, এটাই যদি দশজনকে বলে বা লিখে রাখে, আরও এক যুদ্ধের দিনে তার গল্প করেও মানুষ দুঃসময়কে জবাব দেয়ার দারুণ সাহস পাবে।
মানুষের জন্য কিছু করতে আপনাকে যে মঞ্চেই উঠতে হবে, শাসন দণ্ড হাতে নিতে হবে বা দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী বক্তা হতে হবে, তা নয়।
যুদ্ধের সময় বয়স যৌবন থাকলে তাকে যুদ্ধ করতেই হবে এমন না। প্রথমত, যুদ্ধে যাওয়া না যাওয়া মানুষের স্বাধীনতা। দ্বিতীয়ত, সকলের সুযোগ থাকেনা, পরিবারকে বাঁচাতে, নিজে বাঁচতে মানুষ প্রাণপণ করতে পারে। স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় কথা বলার আগে স্বাধীনতা জিনিসটা কী, এইটা আগে বুঝবেন।
অন্যরা যা করছে সারাদিন এসব দেখতে থাকলে আপনিও তাই করবেন যা অন্যরা করছে।
সিএনএন’র একটা রিপোর্ট পড়লাম গতকাল। মার্কিন গবেষকদের ধারণা, এই ভাইরাসের প্রকোপ সহজে থামবেনা। হয়ত গরমে ধীরে ধীরে কিছু কমবে, কিন্তু আসছে শীতে আবার বাড়তে পারে। মৌসুমের নিয়ম মেনে তারপর আসতে পারে থার্ড ওয়েভ, ফোর্থ ওয়েব। এভাবে কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। সুতরাং, মানুষ এমন অবস্থায় যা করার তাই করবে। অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া। করোনা বা কোভিড ১৯ এর এই প্যানডেমিক কোন যুদ্ধ না। এটা বর্তমান ও আগামী পৃথিবীর একটি চরিত্র যা সব কিছু বদলে দিতে পারে। আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। এবং এই মানসিক প্রস্তুতিই হয়ত সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। এই প্যানডেমিকের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই হয়ত নতুন সমাজ ব্যবস্থা চালু হবে। যে ব্যবস্থা গত কয়েকমাস সারাবিশ্বে চলছে, সেটাই হয়ত আরেকটু গোছানো অবস্থায় দাঁড়াবে।
যে কোন বুদ্ধিমান লেখক জানেন কিসে মানুষের আঁতে ঘা লাগবে। গ্রেট লেখক জানেন ঘা টা কখন মারতে হয়।
উপমহাদেশের মুসলিমেরা ভাবে তাদের ইসলাম স্বয়ং ইসলামের চেয়েও বড়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ। এই তিনদেশে স্বয়ং আল্লাহ এসে যদি তাদের বলেন মসজিদে যেওনা এই দুর্যোগের দিনে, ভিড় কোরোনা ওয়াজ মাহফিল আর জানাযায়, আমার ধারণা তারা আল্লাহকেও বলবে, “আপনি ইসলাম বেশি বুঝেন? আপনার ইমান দুর্বল।”
ঘটনাহীনতা মানেই তো এক অর্থে জমিয়ে রাখার মত স্মৃতির দুর্ভিক্ষ।
একদিন দুর্যোগ কেটে যাবে। আমরা বলবো, “ঘরে বসে বসে কেটে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। ত্রিশ দিন আর এক দিনে যেন বিশেষ কোন পার্থক্য ছিলনা।”
আর এক সময় এও বুঝে যাব, আমাদের অধিকাংশের জীবন এমনটাই ছিল চিরকাল। এক দিনের সঙ্গে অন্য আরেক দিনকে আলাদা করা যেত সামান্যই।
মৃত্যুর মাঝখানে জীবন নিয়ে কথা বলে দেখেন, একটু হলেও ভাল লাগবে। কিংবা, হয়ত সত্যিই ভাল লাগবে। না চাইতেই যা যা পেয়ে গেছি, করে গেছি দিনের পর দিন অবহেলায় ও আগ্রহে, সেসব কত সুন্দরই না ছিল। সেই সুন্দর পৃথিবীতে আবার একদিন আমরা হাঁটব। আবার একদিন।
যারা জেগে উঠছে তারা কখনও ঘুমিয়ে ছিলনা।
মাননীয় অপটিমাস প্রাইম একবারও বললেন না তার যেসব মন্ত্রী, সচিব, কর্মকর্তা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ফাঁপা করে ছেড়েছে তাদের দেখে নেবেন, তিনি ডাক্তারদের দেখে নিতে চান। বাংলার আপামর চিকিৎসকদের নিমের পাচন আর সালসা বানিয়ে রাখতে অনুরোধ করছি। পেশেন্ট আসলে আপনারা টুলস আর অবকাঠামোর অভাবে যায়গা না দিতে পারেন, সালসা দিয়ে দিন এক বোতল করে। তবু লোকে ভাববে চিকিৎসা হচ্ছে।
মিরপুর রেড জোন না হবার কোন কারণ ছিলনা। এই আজকেও দেদারসে লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেনাকাটা করছে। চায়ের দোকানে আড্ডা। ছেলেপেলের হৈচৈ। রোডের একদম শেষ বাড়ি হওয়ায় মোড়ের অবস্থা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি আর হতাশ হই। গত বিশ দিনে মাত্র দু’বার একান্ত দরকারে বাসা থেকে বেরিয়েছি। লাভ কী হল। কোন লাভ নেই।
বৈষ্যম্য হয়ত প্রাকৃতিক। মানুষে মানুষে ভেদাভেদও প্রকৃতির নিয়ম। সৃষ্টির শুরু থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের নিয়তি। এই ভ্রম মাঝেমধ্যে হতে পারে যে, ভেদাভেদ হয়ত মানুষই তৈরি করেছে। মানুষের বড়ত্ব হল, এটা জেনেও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে সে লড়াই করতে চায়। এইসব অনুসিদ্ধান্তে আসার পর আবার নিজের প্রতি কিছু সন্দেহও জিইয়ে রাখলাম ‘হয়ত’ বসিয়ে। এটা অবশ্য চিন্তার প্রতি আগ্রহী মানুষের গুণ। মৃত্যু ছাড়া আর যে কোন কিছুতে নিশ্চয়তা মানেই সম্ভাবনার নাশ।
আমি ছবি আঁকা শিখছি। রেখা, শেপ, ছায়া স্তরে আছি। এবং দেখছি যে অনবরত গাছ আঁকছি। অরণ্যের দিকে যেতে চাইছি। আমার সাব কনশাসে আশ্রয় হিসেবে যে প্রাচীন পৃথিবীর এই অভিভাবকেরা দলবেঁধে আছে আমি জানতাম, এতটা আছে টের পেলাম এই বিপন্ন দিনগুলোয়। বৃক্ষেরা একদিন আবার এই পৃথিবীতে রাজত্ব করবে, এমনও মনে হয় আমার। মানুষ রাজত্ব করার যোগ্য না।
সাহস, বিশ্বাস, আশা: এই তিনটা জিনিস আমাদের বড় অস্ত্র। এগুলো হারানো যাবেনা।
মার্চ ২৬, ২০২০
মহল্লায় সারাদিন লোকজন ছিল। জানালার ওপাশে তাকালে, বারান্দায় দাঁড়ালে, চায়ের দোকানে। কমতে শুরু করেছিল সন্ধ্যা থেকে মানুষ। আর এই রাত সাড়ে এগারোটায় কেমন পুরোপুরি ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। এমনকি কুকুরগুলো, যারা সারা বছর পাড়া ভাগাভাগি নিয়ে রাতের এই প্রহরে ঝগড়া করে, ওরাও চুপ। ঘরে বন্দী মানুষ, সে স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়, যদি উপায়হীন কাজটা করে, প্রথম আঘাতটা আসে নিজের ভেতর থেকে। ভেতর ভেতরে কেউ ফুঁসে উঠে বলে, এভাবে হয়?
ষোল তারিখ থেকে আমার এই অবস্থা, অফিস যেদিন রিমোট করে দিল। নয় নম্বর দিনে আর পারা গেলনা। সন্ধ্যার দিকে আমি বের হলাম। জরুরি কাজ। রিকশায় যাতায়াত। হাইওয়েতে তখনও একটা দুটো বাস ছিল। মানুষ নেই, দোকানপাট বন্ধ। যেন বা যুদ্ধ পরিস্থিতি। মাস্ক পরে আছি, কোলাহল নেই, তাই সবচেয়ে বেশি করে কানে লাগে যেন নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। লোকজন বলাবলি করছে, আজ রাতেই মিলিটারি নামবে।
প্রথম আঘাত নিয়ে বললাম। দ্বিতীয় আঘাত কী? সেটা হল ঐ ব্যক্তিগত উপায়হীনতা আর ক্লান্তির আকারহীন জন্তুটার সঙ্গে চারপাশের চেনা মানুষদের যার যার ব্যক্তিগত জন্তুগুলো সংঘর্ষ। বাইরের আতংক আর রুদ্ধদ্বার পরিস্থিতি যাদের ফেলে দিয়েছে এক যন্ত্রণাদায়ক আলোকিত কুপের মধ্যে। একটা চাপা ভয়, না চাইলেও বারবার নিজের শেষ দেখিয়ে দিতে চাইছে মস্তিষ্ক। যুদ্ধ আর তখন নিজের সঙ্গে থাকতে চাইছেনা।
এসবের মাঝেই নিজের হৃদয়ের আরও এক অংশ এসে মধ্যস্থতা করার শক্তি কিছু ধরে রাখে। সে বলে, “এমন না, এমন না, দুর্দিন যদি আসেই, তখন একে অন্যের মধ্যে সুন্দরটা খুঁজতে হয়, সান্ত্বনা খুঁজতে হয়।”
তাই করতে হবে আসলে আমাদের। প্রথম ধাক্কা সামলে নেয়ার সময়েই প্রস্তুতি নিতে হবে দ্বিতীয় ধাক্কায় হেরে না যাওয়ার। এটা আসবেই। বাতাসে মহামারীর জীবাণু তার ত্রাস ছড়িয়ে রেখেছে, সে শুধু আমাদের জৈবিক দেহের মৃত্যুই নিশ্চিত করতে চায়না, চায় যে মানব-সংযোগের যে গান আমরা গাই মানুষেরা, সেটাকেও ঠুনকো প্রমাণ করতে। তা হতে দেয়া যাবেনা।
জীবাণুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম তাই আমাদের দেহ করুক, হৃদয় দিয়ে আমরা মানুষকে ভালবাসবো। অন্তত, চেষ্টা করতে ক্ষতি তো নেই।
মার্চ ২৩, ২০২০
দুর্যোগটা এসেছে বলেই জানা গেল বাংলাদেশ আজও কত পশ্চাতপদ। জনগণের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও সক্ষমতা কত সীমিত। আর শিক্ষার হার বাড়ার রেশিওটাও কত ফাঁপা, অকার্যকর – এদেশের মানুষ চিন্তা-ভাবনাতেও ত্রিশ বছর পিছিয়ে আছে।
মার্চ ২২, ২০২০
আমাদের বাসায় ছুটা কাজের জন্য একজন মহিলা আসতেন। যেহেতু রোজ বাইরে থেকে আসেন, তাকে আজ বলা হয়েছে বাসায় বসে রেস্ট নিতে। এই ক্ষেত্রে আমাদের যা করণীয়, কয়েক মাসের বেতন তাকে দিয়ে দেওয়া। সেটা করা হবে। কাল হয়ত এসে নিয়ে যাবেন টাকা। উনি বললেন, “আপনাদের বাসাত আইলাম না, অন্যেরা তো মানবোনা।”
জানা গেল আজও আমাদের বাড়ির আরও কয়েকটা ফ্ল্যাটে উনি কাজ করেছেন। একজনের বাসায় আছেন তাদের বৃদ্ধা মা। হয়ত চাইলে ঢাকা শহরের বাড়ির মালিকেরা ইনিশিয়েটিভ নিতে পারেন, খেটে খাওয়া এই কাজের লোকদের কয়েক মাসের টাকা আগাম দিয়ে বাসায় বসে থাকার কথা বলতে পারেন। কিন্তু তা কি মানুষ থাকে? এইসব মানুষেরা অনেকেই চলে যাচ্ছেন গ্রামে। এবং যে কোন সময় তারা ক্যারিয়ার হয়ে অসুখটা গ্রামের দিকে নিয়ে যেতে পারেন।
গ্রামের দিকে করোনা নিয়ে মানুষের ধারণা ভাসা ভাসা। এখনও অনেকের বিশ্বাস এটা শহরের অসুখ, গ্রামে হবেনা। কিন্তু বাংলাদেশে যেমন প্লেনে ভেসে ভাইরাসটি এলো, সারা দেশে তা যেতে পারে বাসে ট্রেনে লঞ্চে চড়ে। এই ব্যাপারের কোন সমাধান আমাদের কাছে কি আছে? সুতরাং গ্রামে যারা আছেন, যারা বোঝেন করোনার বিষয়টা, সচেতনতা বাড়াতে যেটুকু সম্ভব কাজ করুন। চায়ের দোকানের আড্ডা, ফার্মেসিতে বসে গল্প করা, ওয়াজ মাহফিল আর মসজিদ এড়িয়ে চলা (প্রায় অসম্ভব), এগুলোতে মানুষকে উৎসাহ দিন।
মার্চ ২২, ২০২০
সবাই শুধু বলছে। কেউ কাউকে শুনতে পাচ্ছেনা।
এখন পর্যন্ত যত উপন্যাস পড়েছি আর পাঠান্তে সেসবকে মহৎ মনে হয়েছে, সবগুলোই বিষণ্নতা উৎপাদক। খোঁচা মেরে জাগানো বিষণ্নতা না। যেন বেঁচে থাকার অর্থ নেই আর অর্থ নেই জেনেও তা খুঁজে পাবার জন্য আকুল মানুষের দীর্ঘ সব যাত্রা। উপন্যাস পড়তে পড়তেই আমি জেনে চলেছি কীভাবে একে অন্যের অতীত-বর্তমানে আমরা প্রবেশ করছি প্রতিনিয়ত, সবাই একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কাটিয়ে যাচ্ছি অভিন্ন জীবন।
সরাসরি “না” বলবার নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে আমরা ছোট ছোট কথা দেই মানুষকে। অতঃপর সেই না রাখতে পারা কথাগুলো হয়ে ওঠে বড় বড় বিষ।
গডফাদার সিনেমার কৌশল বিষয়ক একটা টুকরো দৃশ্য মাথায় ঘুরছিল। দ্বিতীয় পর্বে আছে ঘটনাটি। ভিতো তখন যুবক, মহল্লায় সবে তার প্রভাব তৈরি হচ্ছে। এক বুড়ি ইতালিয়ান এসেছেন কুকুর বিষয়ক ঝামেলা নিয়ে, কুকুরের কারণে বাড়িঅলা তাকে তাড়িয়ে দেবেন। এখন এই বাড়িঅলা বিষয়ক তুচ্ছ সঙ্কটটি কীভাবে ভিতো সমাধান করেন, মাত্র দুটি দৃশ্য দিয়ে তার ভবিষ্যতে গডফাদার হয়ে ওঠার বিষয়টি কত শক্তিশালিভাবেই না দেখানো হয়ে যায়। গত একশ বছরে সিনেমা ও সাহিত্য যে মিলেমিশে গিয়েছে, ক্ষেত্রটিতে এ ধরণের অজস্র টুকরো টুকরো দৃশ্যই গডফাদারকে করে তুলেছে ভিজুয়াল মিডিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়।
দাঁতে বেদনা, মাথায় পেইন, গরমেও যন্ত্রণা। কী দারুণ শারদীয় সময় কাটছে। অবশ্য শরৎ আসতে দিন চারেক বাকি আছে গুগল ক্যালেন্ডার মারফত। এর মধ্যে মিরপুরের রাস্তাঘাট আতরের গন্ধে ভরে উঠছে সঙ্গে দুলদুলের ছদ্মবেশি শিশু-কিশোর, ঢোলের অত্যাচার। সঙ্গে আছে ইমাজিনেশন নামক নৌকার দুলুনি, নাজি ক্যাম্প ভেঙে পালাচ্ছেন স্টিভ ম্যাককুইন, তারপর উঠে পড়ছেন সবুজ রঙের মাস্টাঙে–যাবেন সমুদ্রে, তার পেটে পাঁচ পাউন্ড ওজনের একটা টিউমার, মেহিকোর এক অখ্যাত হাসপাতালে গিয়ে সেই টিউমার কাটাবেন। ইত্যাদি।
বেশ, ফরাসীরা ট্যাকটিকাল ফুটবল খেলে চ্যাম্পিয়ন হল। তাদের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন স্তাঁদালের কথা ছিল একটা, সৌন্দর্য্য হচ্ছে সুখের প্রতিজ্ঞা। সারারাত স্তাঁদালের Le Rouge et le Noir (লাল ও কালো) পড়ে কাটিয়ে দিতে পারি, কিন্তু ফরাসীদের এই ফুটবল আমার অপছন্দের তালিকায় রয়ে যাবে। পরের গোলটা, যেটা ছিল এক অনিচ্ছাকৃত হ্যান্ডবল, ঐ পেনাল্টি ম্যাচের মেজাজ নষ্ট করেছিল, আর আঁতোয়ান গ্রিজমানের আদায় করা ফ্রি কিকটাও আনফেয়ার ছাড়া অন্য কিছু ছিল কি? ক্রোয়েশিয়ার এই দারুণ খেলা দলটিকে নিশ্চয় ফুটবলপ্রেমীরা মনে রাখবে। ফলাফল মনে রাখে মানুষ, পরাজিতদের ভুলে যায়। কিন্তু ফুটবলের অমরত্ব তার সৌন্দর্য্যেই।
France only won the results today. Mbappé is a disgrace to football. And, that’s what we called a match shocking like a Greek tragedy. Dear team Belgium, you will be remembered as “team Brazil 1982” is being remembered always. Football, you crazy, shit, bastard, beauty!
বিদায় সুপ্রিয় লিও মেসি। পুরাণের ট্র্যাজিক মহানায়ক হিসেবেই আপনি স্মরণীয় হবেন। এ নিয়তি অমোঘ কুঠারাঘাতের মতই। আমরা মনে রাখব।
কথাবলার অধিকার শুধু কি সাধুর থাকবে? চোরেরও অধিকার আছে। ক্ষমতা সব সময় দু’দলের কন্ঠ চেপে ধরতে চায় এবং নিজের সুবিধার্থে কখনও সাধুকে বা কখনও চোরকে অধিকার ফিরিয়ে দেয় সাময়িকভাবে। এদের মাঝে যারা শিল্পী, তাদের কাজ হচ্ছে ক্ষমতার ত্রুটিগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত সমালোচনা করা। সুনাম করবার জন্য ক্ষমতা চিরকাল একদল চাটুকার পালে, জনকল্যাণ হলে তো কথাই নেই, যে কোন জনবিপর্যয়েও এইসব চাটুকারের দল ক্ষমতার সুনাম করতে থাকে। শিল্পীর অবস্থানটা অবশ্যই এদের থেকে আলাদা, আধুনিক যুগের সেটিই দাবি, নইলে আর শিল্প করা কেন!
লেখকের জীবন হওয়া উচিত ঘুরেঘুরে বেড়াবার। আজ এ গাঁয়ে, কাল ও নগরে, পরশু পাহাড়ে ও সমুদ্রে। নিজ মাটি ও মানুষের ছোঁয়া নিয়ে নিয়ে তবেই না গড়ে ওঠে লেখকের জীবনবোধ, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। তা না, এই সময়ে নগরবন্দী আমরা যারা লেখালেখি করি, এই গুমোটে দিনরাত্রি অনবরত পার করতে করতে মনে হয় যেন ডুবে যাচ্ছি, বিষণ্নতা ছাড়া আমাদের আর কোন নির্যাস নেই।
সেই মোটা ও কদাকার, খোদার সঙ্গে নিত্য রজনীতে বাৎচিত করনেওয়ালা লোকটিকে এ নগরের লাখ লাখ মানুষ মাথায় তুলে রেখেছে। গহন রজনীতে যেমন ভূতের নাম নিতে ভয় পায় গাঁয়ের লোক, সচেতন কিংবা প্রগতিশীলেরাও কল্লা উড়ে যাবার আশঙ্কায় ওর নাম করেন না। শূন্যদারকায় একবার বাসের জ্যামে বসে সেই উন্মাদের বক্তব্য শুনতে শুনতে অবাক হয়েছিলাম, কত কত লোক, কত কত অর্থ আর জীবন ওর পায়ে ফেলে দিচ্ছে। মানুষগুলোর চোখে মুখে স্বর্গের লালসা আর পৃথিবীর প্রতি ঘৃণা।
ধরা যাক, এমন বৃষ্টি হতে থাকবে অনন্তকাল। ঢাকার বৃষ্টি ছাপিয়ে যাবে মাকোন্দোর বর্ষাক্রান্ত বিশ বছর আর আমরা ঘুমে ও জাগরণে পড়ব ভুতের গল্প। নগরীর রৌদ্রস্নাত দিনের চেয়ে এই ভাল। যেভাবে খরার চেয়ে বন্যা সাধু হয়, গ্রামের সবচেয়ে ভাল লোকটি গাছের ডালে দাঁড়িয়ে পেশাব করে।
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে রিচার্ড হোমসের জ্যাজ, ম্যাডোনার পপ, এরপর ক্রোচে থেকে প্রিসলি, কয়েক ফোঁটা জন ডেনভার আর সতীনাথ, শ্যামল এবং শেষে লানা কিংবা লিজি গ্রান্ট–এই ককটেল মাথায় যে ঘোর তৈরি করে, পৃথিবীর আর কোন কিছুতে কি সে ঘোর তৈরি হয়? নগরের দুপুর আর ঘোর সংকটে আপনি যখন পালাতে চাইবেন পৃথিবী ছেড়ে, এরা বারবার আপনাকে সকল গ্লানির মাঝখানে আসন করে দেবে, কানে কানে বলবে সমাধান আছে, সমাধান আছে।
নারীবাদ কি নারীকে প্রকৃত নারী করে তুলতে পারে? নাকি নারীকে পুরুষ করে তোলাই এ আন্দোলনের সুপ্ত প্রেষণা? নারীমুক্তি কি ঘুরে ফিরে পুরুষতন্ত্রেই নিহিত? এসব ভাবতে ভাবতে হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস আগুনপাখির একটা লাইন মনে পড়ল: আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলেদা মানুষ।
বাসার কাছেই আগুন লেগেছিল, মিরপুর ১২ নম্বরের বস্তিতে, রাত তিনটায় ঠিক যখন আমি বিছানায় গিয়েছি একই সময়ে কত মানুষের আবাস ভস্ম হয়েছে মুহূর্তে। এত কাছে, তবু সে সংবাদ পেয়েছি সকালে। কেউ মারা যায়নাই শুনে যখন একটু হলেও স্বস্তির শ্বাস ফেলব তখন কাঠমান্ডুতে বিমান দুর্ঘটনার খবরটা সব অন্ধকার করে দিল। কী ঠুনকো জীবন। সেই মুহূর্তে ফুরিয়ে যাবার শংকায় কাঁপতে থাকা জীবন নিয়ে কত আয়োজন, কত তর্ক আর মৈত্রী আমাদের!
নিষিক্ত হবার জন্য একটা শুক্রাণুও তার অন্যান্য সঙ্গীদের ফেলে রেখে আসে পিছে, তার যাত্রাই শুরু হয় নিঃসঙ্গতার মাধ্যমে। মানুষ এই একাকীত্বের বিরুদ্ধে নানাপদের সংগ্রাম করে জীবনভর। সে চুড়ান্তভাবে এই পৃথিবীতে একলাই, এটা মেনে নিলে কিছু ল্যাঠা চুকে যেতে পারত, কিন্তু পারেনা, যেমন সে মেনে নিতে পারেনা মৃত্যুকে।
কেন মানুষকে বাঘ বললে খুশি হয় আর গরু বললে অপমান? ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ আর দুর্বলের প্রতি ঘৃণা থেকেই আমাদের মাঝে ব্যাপারটা চালু হয়ে গেছে। এই বিষয়ে আলাপের পর আমায় একজন বললেন, তাহলে কি আপনাকে গরু বলে ডাকব? ভাল কোন কাজের পর আপনাকে ডাকলাম, আপনি একটা গরুর বাচ্চা? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাকে জানিয়েছি, মানুষের বাচ্চাই বলুন। মানুষ হয়ে জন্মেছি, আমি বাঘ-সিংহ, গরু-মহিষ কোন কিছুর সঙ্গেই নিজেকে তুলনা দেবনা।
“ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো”, এর চেয়ে ভাল কোন বাক্যে নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারিনা আমি। সঙ্গে যোগ হয়, হেমিংওয়ের এই লাইন, Writing, at its best, is a lonely life. For he does his work alone and if he is a good enough writer he must face eternity, or the lack of it, each day.
আমারে একবার এক গুরুস্থানীয় বলেছিলেন : লেখো ভাল, পরমানন্দ লাভের পরেই যেমন নারী-পুরুষ নেতায় পড়ে আর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যায়, অমন লেখা কখনও লিখবানা। যেন তুমি লিখলা, আর কেউ পড়লে তার ভ্রু কুঁচকায়া যায়, হৃৎপিন্ডে যেন কেউ খামচি বসায়েছে এমন বেদনা জাগায়, ভিতরে ভিতরে মানুষ যে কত অসহায়–সেই অসহায়ত্ব আর বিষণ্নতা যেন তারে আরেকজন মানুষকে অধিক ভালবাসার দিকে নিয়া যায়, এইরকম লিখতে পারলেই, অন্তত যদি এমন লিখতে চাও–লাইনে থাইকো। নাইলে ফ্লোর ঝাড়ু দাও, ছাত্র পড়াও, কামলা খাটো ব্যাংকে আর ময়দানে, এমনকি দেশের প্রাইম মিনিস্টারও হয়া যাইতে পারো তুমি কিন্তু শব্দের সঙ্গে তোমার হইবনা, শব্দে স্রষ্টার নিবাস।