
সিরিজ দেখেছি আগে। আ গেম অব থ্রোনসের গল্প তো জানা। তবু কত কিছু নতুন করে পাওয়া গেল। বইয়ের জগৎ আরও বিশাল, ম্যাজিকাল। উদাহরণ দিতে স্মরণ করবো এইরির কথা। সেটায় পৌছতে ক্যাটলিন আর টিরিয়নকে যে পাথুরে-পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়, সিরিজে ওই এডভেঞ্চারের পুরোটা মোটেও আসেনাই। ক্যাসল ব্ল্যাকে জনের প্রথম ওয়াইটকে মারার ঘটনাটিও আরও ভয়ানক। স্টার্কদের সঙ্গে ডায়ারউলফদের গভীর কানেকশন উপন্যাসের আরও একটা উল্লেখযোগ্য দিক। এ বইয়ের ক্রাফট যে কী অনন্য। এত বিশাল স্টোরি আর্ক, কিন্তু কোথাও এক বিন্দু বিরক্তি আসেনা, চুম্বকের মত টানে। চারিত্রিক জটিলতা পরিষ্কার করতে হয়ত এমন সহজ আর গভীরের মিশ্রণ লাগে ভাষায়। আমি মুগ্ধ। কৃতজ্ঞ থাকবো আসলে সিরিজটার প্রতিই। এত অসাধারণ টিভি সিরিজটার কারণেই তো এ বইয়ের কাছে আসা হল। বাকি বইগুলো পড়ার সুযোগ হবে কিনা জানিনা। হলে নিশ্চয় পড়ব।
এক্সুপেরির ‘ছোট্ট রাজপুত্র’ পড়লাম গতকাল। এক ঘণ্টার ঝটিকা সফরে যেন পৃথিবী ঘোরা হল। আনন্দ পেলাম, মন খারাপও কম হলোনা। রহস্য, কল্পনা, ভালবাসা আর বন্ধুত্বের মাঝখান দিয়ে ছোট্ট রাজপুত্র আমাকে শিখিয়ে গেল দর্শনের সেই চিরায়ত বাণী: আমাদের বিশ্ব দেখবার চোখে চিরকালই যেন শিশুর কৌতুহল থাকে, কেননা বড়দের হিসেবি দুনিয়া আর অভ্যেসের জগৎ বেঁচে থাকাকে নতুন কোন অর্থ দিতে পারেনা। তৃষ্ণা মিটলোনা একবার পড়ে। এ বইয়ের কাছে বারবার ফিরতে হবে।
গত কয়েকদিনে পড়া হল রহু চণ্ডালের হাড়। এমন অনাসক্ত আর মেদহীন ভাষায় একদল মানুষের চরিত্র নির্মাণ কঠিন ব্যাপার। অভিজিৎ সেন সেটা করেছেন মগ্ন কুশলতায়। গল্পের যা টান, রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলা গেল শারীবা, লুবিনি, জামির, পিতেম আর মালতীদের এই আখ্যান। যারা না মুসলিম, না হিন্দু, না খৃষ্টান, যারা এটা বারবার ভুলে যেতে চায় যে তারা আসলে বাজিকরের জাত। আসা যাক বইটির নৃতাত্ত্বিক গুরত্বের ব্যাপারে। এ বই তুলে এনেছে প্রায় লুপ্ত বাজিকর নামের এক যাযাবর সম্প্রদ্বায়ের ভাসমান জীবনের গল্প। পৃথিবীর বুকে একদল হতভাগ্য মানুষের যায়গা করে নেবার সংগ্রাম।সামনে কখনও বিস্তারিত লিখব এ বই নিয়ে। ঔপন্যাসিকের যে আড়াল পাঠকের থেকে, তা হয়ত লেখক রাখতে পেরেছেন। বইটা কোন একভাবে কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, লেখকের জীবদ্দশাতেই। এমন জটিল বিষয় নিয়ে লেখা সুখপাঠ্য উপন্যাস বাংলাসাহিত্যে বিরল।
জার আমলে রাশিয়ান উচ্চবিত্ত রমণীরা কেমন ছিলেন? দস্তয়েভস্কির নভেলা খুড়োর স্বপ্ন (Dyadushkin son) তার অনুপম দলিল। শুধু শরীর তো এই লেখক দেখান না। দেখান একেবারে হৃদয় খুঁড়ে। ছোট হলেও ধীর গতির। থেমে থেমেই পড়েছি এ’কদিন। যেহেতু বিস্মৃতিপ্রবণ এক বুড়ো জমিদারের কাহিনী, তার বিস্মৃতি কালো কৌতুকে ভরা। এ অবলিভিয়ন যেন প্রাচীন সামন্তকেন্দ্রিক রাশিয়ার এক ভীতিকর গোপনীয়তা উন্মোচন। ভোগ প্রবণতায় ডুবতে ডুবতে মানুষ যে এক সময় নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, নিজেকেও ভুলে যায়, সেই দৃশ্য লেখক এঁকে গেছেন প্রতি পৃষ্ঠায়। শুরুর দিকে যে গল্পকে শুধুই রাশিয়ার গল্প মনে হয়, শেষের দিকে এসে তা হয়ে ওঠে সারা পৃথিবীর। সুপ্রিয় দস্তয়েভস্কি, প্রণাম আপনায়, মায়েস্ত্রো।
বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ চরিত্রটির নাম হোসেন। বিষাদসিন্ধু পাঠের বড় পাওয়া হয়ত এমন একটা চরিত্র আবিষ্কার। ঐতিহাসিক ত্রুটি ছাপিয়ে এ উপন্যাস শুধু গল্পের মোহে পড়ে ফেলা যায়, প্রকাশের এই একশ বছর পরেও। এক সার্থক এপিক, সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে হাই ফ্যান্টাসির বিবিধ উপাদান। মীর মশাররফের ভাষাও অতুলনীয়, একই সঙ্গে ক্লাসিকাল মিউজিকের স্বাদ দেয়, সহজ পাঠেও ক্লান্তিহীন।
ফেলুদা যত না গোয়েন্দা কাহিনী, তারচেয়ে বেশি ভ্রমণ কাহিনী। বাদশাহী আংটি আর সোনার কেল্লা পড়া হল উইকেন্ড জুড়ে। লক্ষ্ণৌ, লছমনঝুলা থেকে যোধপুর, জয়সালমির – কী অপূর্ব সময়ই না কাটলো। এবং এই সাতাশে এসেও, মানে প্রদোষ মিত্তির আর আমি এখন সমবয়সী, কাহিনীর রস একটুও কমেছে মনে হলনা। সত্যজিৎ এখানেই অনেকের থেকে আলাদা। গল্পকার হিসেবে মাস্টারক্লাস। কিশোর বয়সে তিনি ছিলেন আমাদের ম্যাজিশিয়ান, এখন যৌবন, তবু তার ম্যাজিক স্পেল অনিঃশেষ।
মানুষ পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য খুঁজতে থাকে। অজস্র ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে হলেও। কারও কারও ব্যর্থতা এমন বিশাল হয় যে, ওতে বদলে যায় মহাদেশের ইতিহাসও।
বৃটেনের ওয়াল্টার র্যালে আর ভেনেসুয়েলার ফ্রান্সিসকো মিরান্ডার জীবনও সেরকম। একজনের দীর্ঘ অসফল এল ডোরাডো অভিযান জোরদার করেছিল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বৃটিশ কলোনিয়ালিজমকে, অন্যজনের ঐ অঞ্চলেই স্প্যানিশ কলোনি থেকে মুক্তির ব্যার্থ সংগ্রাম কাজ করেছিল সিমোন বলিভারের মত লাতিন আমেরিকান কিংবদন্তির উত্থানে।
নাইপল এই ইতিহাসের কুশলী রিটেলিং করেছেন, সঙ্গে যোগ হয়েছে এ অতীত খননের পেছনে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর ছোট্ট দ্বীপ থেকে উন্মুক্ত পৃথিবীর দিকে তার যাত্রা আর এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্লেয়ার, যে কুটনৈতিক যুদ্ধ চালিয়েছিল ক্যারিবীয় অঞ্চলে স্বজাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় – কেন তাকে হত্যা করা হল, তার কারণ অনুসন্ধান।
এক অর্থে, নাইপলের নিজ ভূখন্ড, আসলে ক্যারিবিয়ান ভূখন্ডের গোপন ইতিহাস এ বইয়ে অনেকটা উন্মোচিত হয়েছে। কিছু কিছু যায়গা দুর্দান্ত, কিছু কিছু যায়গা পড়তে একদম ইচ্ছে করেনা। তবু, বইটা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ভিতর থেকে বেরিয়ে যায়।
উপন্যাস, ডকুফিকশন, সিকোয়েন্স – কিসে কী হয়ে ওঠেনা, উপন্যাসের কাঠামো কী বস্তু, আদৌ তেমন কিছু একজন লেখক মানবেন কী না, আ ওয়ে ইন দা ওয়ার্ল্ড পড়তে পড়তে তাও শেখা যায়।
সুখপাঠ্য এ বই নয়। অকপটেই বলা চলে, সুখপাঠ্য লাগবে এমন আশ্বাস কিছু বই ও কোন কোন লেখক কখনই দেন না।
কিছু বই পাঠের পর বিপন্ন লাগে। শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সেরকম একটা বই। বদু মওলানারা আজিজ পাঠানদের আশ্রয়েই আবার পুনরুত্থিত হয়, আর লক্ষীবাজারের আব্দুল মজিদ হয়ে ওঠে জীবন হাতে পলাতক সকল আম জনতার প্রতিনিধি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি এই বাস্তবতা কঠোর হয়েই বাংলাদেশের হৃদয়ে ঘা মারছে আজও। মাত্র ৫৩ পৃষ্ঠার পরিসরে জহির এক মহাকাব্যই লিখতে পেরেছেন। বিষয় ও পরিমিতি বিবেচনায় এর সঙ্গে তুলনীয় বই বিশ্বসাহিত্যে বিরল।
জীবনের উপরের স্তরগুলো যত নিরস, ভিতরের স্তরগুলো তার সঙ্গে তুলনামূলক উত্তেজনাপূর্ণ। সরল রেখার গতি যেমন একরৈখিক, ভিতরে ভিতরে জীবন বহুরৈখিক, ঠিক একটা গোলকধাঁধার মত। এই গোলকধাঁধার নিয়ন্তা হল আমাদের মানবিক দুর্বলতা, মুক্তিদাতা আমাদের শুভবুদ্ধি। কিন্তু মুক্তিই কি শেষ কথা? খাঁচায় থাকতে থাকতে পাখি খোলা আকাশের স্বাদ ভুলে যায়না? হারুকি মুরাকামির আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ জীবনের এই লুকানো স্তরগুলোকে সামনে টেনে আনে।
নির্মাণ ও বর্ণনা, ব্যবহৃত সাহিত্যিক কৌশলে দারুণ অভিনব বই। রহস্য, পুরাণ, নাটকীয়তা, প্রেম ও অভিযান সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্বিতীয় আবেশ তৈরি হয় পড়তে পড়তে। বিশ্বসাহিত্যের ‘অদ্ভূত উপন্যাস’ সম্ভারে এই বই উঁচুর দিকে থাকবে। এ মুহূর্তে তুলনা করতে হলে, হোর্হে লুইস বোর্হেসের ‘ইবনে হাকাম আল বুখারি ডেড ইন হিস ল্যাবিরিন্থ’ গল্পটিকে স্মরণ করা যেতে পারে।
বইটা পড়লাম, আসলে একটা সাক্ষাৎকার সংগ্রহ। ১৯৬৭ সনে মুখোমুখি কথা বলছেন দুই ঔপোন্যাসিক—চিলের মারিও বার্গাস ইয়োসা আর কোলোম্বিয়ার গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। দু’লেখকের খুঁটিনাটি আলাপ রীতিমত বিশ্বসাহিত্যের একটা অমূল্য পাঠ আমাকে দিল—সবচে’ বড় পাঠটির কথা বলি : বার্গাস ইয়োসা যখন মার্কেসকে জিজ্ঞাসেন লাতিন আমেরিকান বুম সম্পর্কে (দক্ষিণ আমেরিকার তুঙ্গস্পর্শী সাহিত্যিক উত্থান), এটি কি শুধুই লেখকদের দুর্দান্ত সব উপন্যাসের কারণে সম্ভব হয়েছে? তখন মার্কেস জবাব দেন, মনে হয়না যে শুধু লেখকদের দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়া মেধায় এটা সম্ভব হয়েছে, বরং পাঠকেরা আবিষ্কার করেছেন নিজেদের লেখকদের নতুন করে—আগের চাইতে লাতিন পাঠকেরা বেশি মনযোগী হয়েছেন নিজেদের লেখকদের প্রতি। সুতরাং লাতিন আমেরিকান বুম আসলে লাতিন পাঠকদের বুম।
চমৎকার এ বইটি পাঠের সুযোগ করে দেবার জন্য রফিক-উম-মুনির চৌধুরীকে ধন্যবাদ। সরাসরি এস্পানিওল থেকে বইটি তিনি বাংলা করেছেন—সংবেদ থেকে বেরুনো ছোট্ট এ গ্রন্থটিকে পাঠ জীবনের এক অমূল্য সংযোগ বলেই মনে হচ্ছে এখন।
জাকির তালুকদারের উপন্যাস কুরসিনামা পড়লাম। পাশাপাশি দুটি কাহিনীর একটি লেখা হয়েছে মধ্যযুগের কবি শুকুর মাহমুদের কাব্য গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস অবলম্বনে, টানা পড়ে গিয়েছি—কী অসাধারণই না এর আখ্যান, লোকায়ত মিথ আর জীবন মিলেমিশে মশগুল। প্রাপ্তবয়ষ্কদের এ কাহিনী যে জাকির তালুকদার ফিরবার করলেন, তার আঙ্গিক একেবারে শিশুপাঠ্য সাহিত্যকণিকার মত ঠেকেছে, পরিণতির দিকে যাবার ঝোঁক সর্বদেহ জুড়ে—দূর্দান্ত আখ্যানটিতে প্রাণ কোনমতেই প্রতিষ্ঠা পায়নি হয়ত সেজন্যেই। সাহিত্যে পূর্বসৃষ্ট কোন চরিত্র কিভাবে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায়—কুরসিনামার গুপিচন্দ্র তার উদাহরণ। একইভাবে অপর আখ্যানে যুদ্ধশিশু দুলালের যে গল্প আমরা পাই: সেটি হৃদয়বিদারক ও বিবর্ণ, বিবর্ণ এই কারণে যে দুলাল আমাদের অচেনা কেউ না কিন্তু কুরসিনামায় তার চলাফেরা দাঁড়িয়েছে ডকুমেন্টারির সাক্ষাৎকারদাতার মত, যেন সাংবাদিক খুব ব্যস্ত–দুলালের কথা গহন মনযোগে শুনছেন না তিনি, একটা কথা শেষ না হতেই নয়া প্রশ্ন করছেন এইরকম।
সুতরাং কুরসিনামা সার্থক উপন্যাস হয়ে উঠলোনা। তবু যা বলার: সবমিলিয়ে এ বই সুখপাঠ্য। গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস কাব্যটি সমস্তপাঠের ইচ্ছে জেগে উঠবে শেষান্তে—আহা, এইরকম কাহিনী কি হারিয়ে যেতে পারে?
কাঁদো নদী কাঁদো পড়তে পড়তে একে বড় আপন মনে হয়, সুতরাং বহুপাঠেও উপন্যাসটিকে পুরাতন লাগেনা। এর উপরে একপাল বিষণ্ণ মেঘের মত ছায়াবিস্তার করে রাখা জাদুবাস্তবতাকেও মনে হয় নিকটের নির্যাস। নদী তো কাঁদেই, আপনারা শুনতে পান না?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন উঠতি কবি, সমবয়সী হওয়া স্বত্তেও পূর্ণেন্দু পত্রী তদ্দিনেই ডাকসাইটে আর্টিস্ট। আত্মজৈবনিক অর্ধেক জীবন’র একটা অধ্যায়ে পত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা এভাবে লিখেছেন, “একবার দীপক আমাকে নিয়ে গিয়েছিল পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছে। দীপকই কথাবার্তা বলল, আমি তার পেছনে ছায়ার মতন, একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি, পূর্ণেন্দু আমার নামও জানতে চায়নি। পূর্ণেন্দুও গ্রাম থেকে এসেছে কোলকাতায়, কিন্তু তারই মধ্যে কন্ঠস্বরে অহংকারের ছাপ ফুটে ওঠে, যেন দুটো এলেবেলে বাচ্চা কবি এসে তার সময় নষ্ট করছে।”
অর্ধেক জীবনে এমন একটা দৃশ্য আছে, দেবী সরস্বতীর প্রতিমায় চুমু খাচ্ছেন কিশোর সুনীল। এ নিয়ে আবার বুদ্ধদেব গুহ মন্তব্য ছুড়েছিলেন, “লোকরঞ্জনের জন্য অমন স্বস্তা গিমিক আমি সমর্থন করিনা।” খানিক হাসিও পেল তখন, গুহের লেখা বিপু লাহিড়ীর আত্মচরিত’র কথা মনে পড়ল।
২১ বছর বয়সি অস্কার তার পিতা আলফ্রেড মাজেরাথের কবরে ফেলে দেয় চিরসঙ্গী লাল-শাদা টিন ড্রাম আর বড় হয়ে উঠতে শুরু করে; ভাঙতে থাকে তার তিনফুট উচ্চতার পৌরাণিক জীবন। অস্কার কেন এমন করে? যুদ্ধ ও জীবন দায়িত্ববোধের এক সুতীব্র আবেগে তাকে বড় হতে আহ্বান জানায়, এইজন্য?
শেষ কোন বই আমাকে এতদিন ধরে সঙ্গ দিয়েছে খেয়াল হচ্ছেনা। গুন্টারগ্রাসের আঙ্গিক এবং বক্তব্যের গভীরে আরও বক্তব্য সৃষ্টি করবার ক্ষমতা একেবারে নিজস্ব, অদ্বিতীয়। উপন্যাসের আবহ খুব স্বাভাবিক থেকেও অস্বাভাবিক, অস্কারের শীতল উন্মাদনা আর চারপাশে সুস্থ মানুষগুলোর বিমর্ষ পাগলামি এবং যুদ্ধ থেকে দূরে থেকেও সকলের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার দুঃস্বপ্ন–সমস্ত মিলিয়ে দা টিন ড্রাম এক সমৃদ্ধ, দূর্লভ পাঠ অভিজ্ঞতা।
জীবনের উপরের স্তরগুলো যত নিরস, ভিতরের স্তরগুলো তার সঙ্গে তুলনামূলক উত্তেজনাপূর্ণ। সরল রেখার গতি যেমন একরৈখিক, ভিতরে ভিতরে জীবন বহুরৈখিক, ঠিক একটা গোলকধাঁধার মত। এই গোলকধাঁধার নিয়ন্তা হল আমাদের মানবিক দুর্বলতা, মুক্তিদাতা আমাদের শুভবুদ্ধি। কিন্তু মুক্তিই কি শেষ কথা? খাঁচায় থাকতে থাকতে পাখি খোলা আকাশের স্বাদ ভুলে যায়না? হারুকি মুরাকামির আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ জীবনের এই লুকানো স্তরগুলোকে সামনে টেনে আনে।
নির্মাণ ও বর্ণনা, ব্যবহৃত সাহিত্যিক কৌশলে দারুণ অভিনব বই। রহস্য, পুরাণ, নাটকীয়তা, প্রেম ও অভিযান সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্বিতীয় আবেশ তৈরি হয় পড়তে পড়তে। বিশ্বসাহিত্যের ‘অদ্ভূত উপন্যাস’ সম্ভারে এই বই উঁচুর দিকে থাকবে। এ মুহূর্তে তুলনা করতে হলে, হোর্হে লুইস বোর্হেসের ‘ইবনে হাকাম আল বুখারি ডেড ইন হিস ল্যাবিরিন্থ’ গল্পটিকে স্মরণ করা যেতে পারে।
স্প্যাগেটির বছর বা দ্যা ইয়ার অফ স্প্যাগেটি নামে হারুকি মুরাকামির একটি ছোটগল্প পড়লাম। এমন নতুন কিছু না। এক লোক সারা বছর শুধু স্প্যাগেটিই খেয়ে চলে। তার স্মৃতিচারণে ঐসব দিনের বর্ণনা। নানান ভাবে স্প্যাগেটি রাঁধা হচ্ছে, খাওয়া হচ্ছে নিঃসঙ্গ এক লোকের। ঠিক যেমনটা ঢাকা নগরের অজস্র মেসবাসি অবিবাহিত ছেলেরা খায়, ভাত ডিমভাজা ভাত ডিমভাজা ভাত। এই নতুন কিছু নায়ের মাঝেই গল্পটা শেষ করে মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। মনে হল, গেল কয়েক বছরে আমার পড়া ছোটগল্পের মাঝে এটি শ্রেষ্ঠদের কাতারে থাকবে। সঙ্গে ধারণা করি, মুরাকামির এ গল্প হেমিংওয়ে প্রভাবিত। বিশেষত স্মরণ হচ্ছে হিলস লাইক হোয়াইট এলিফেন্টস’র কথা।
সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস জাগরী পড়ছি। প্রথম পাঠে বিলুকে নিকটস্থ কেউ মনে হয়না, দ্বিতীয় পাঠে তার আবেগগুলো কেমন আপন হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের ৪২ সনের অগাস্ট আন্দোলনের (গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলন) প্রেক্ষাপটে রাজবন্দী একটি পরিবারের চার সদস্যের গল্প, তাদের বর্তমান–তাদের অতীত মিলেমিশে একাকার এইখানে। বিলুর জবানীতে আছি, বৃটিশ আমলে বিহারের কেন্দ্রীয় জেলখানায় কয়েদী আর জেল স্টাফদের জান্তব বর্ণনা মিলছে–মিলে যাচ্ছে তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনে কর্মী-নেতা-আমলোকের মনস্তত্ত্ব।
যে সমস্ত বই পড়ছি একসঙ্গে, ভাবলাম তা টুকে রাখা যাক।
১। তলকুঠুরির গান//
ঔপোন্যাসিকের নাম আমার চেনা, আগে পড়বার সুযোগ হয়নি। ওয়াসি আহমেদ। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, এক মনোরম আধুনিক উপন্যাস পড়ছি। চরিত্র নির্মাণ এখন পর্যন্ত দারুণ। নানকার বা রুটিদাসদের বেদনা নিয়ে লেখা এ উপন্যাস টুয়েলভ ইয়ার্স আ স্লেভের বেদনার সঙ্গে সমানুপাতিক। আমাদের বুক চিরে কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা হাহাকার জাগায়, কিন্তু এখন পর্যন্ত অজানা নানকার, এই একশ বছর আগেও এদেশে কেমন নিষ্পেষিত হয়েছে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
২। কারখানার বাঁশি//
কথাশিল্পী হামিম কামালের প্রকাশিতব্য উপন্যাসের পান্ডুলিপি। সরাসরি বাঁশি যারা শুনেছেন, তারা এর মোহনীয়তা জানেন, যারা শোনেননি তারা করতে পারেন অনুমান। আগামী দিনগুলোয় এ দু’দলই কারখানার বাঁশি পড়বেন, এমনটাই অনুমান হচ্ছে।
৩। শ্রীকান্ত//
শেষ খন্ডে আছি। পাঠ চলছে একদম ধুঁকে ধুঁকে। এমন খুলে খুলে কলকব্জা আলাদা করে এর আগে পড়া হয়নি শরৎ বাবুকে। মাস্টারপিস, আমি না বললেও তাই রয়ে যাবে।
৪। আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ//
এ বই গানহি বাওয়ার। মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর। শুরু হয়েছে মাত্র। এখনই কোন মন্তব্য করবনা।
বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়াই ঘুম ভেঙে, কী ভেবে অজস্র লেখকের ভিড় থেকে জগদীশ গুপ্ত’র ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ হাতে উঠাই আর পড়ে ফেলি ‘দিবসের শেষে’। কোন কারণ ছিলনা এ পাঠের, হুট করেই। কিন্তু একটা ছোট্ট গল্প, কেমন বিপুল তার প্রতিক্রিয়া, ঝড় বইছে মগজে। রতি নাপিতের ছেলেকে কি আসলেই কুমিরে নেবে? এই কুমির কোন কুমির? অস্বস্তি কাটেনা।
ওয়াসি আহমেদের উপন্যাস তলকুঠুরির গান শেষ হল। সরল দাগে সিলেটের রুটিদাস নানকারদের আন্দোলন, তাদের মানবেতর দুঃসহ জীবনের কাহিনী কি একে বলব? উপন্যাসের স্বর শুধু সেখানেই জমে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে বর্তমান অব্দি। আধুনিক যুগেও মানুষ তার জীবিকা ও যাপনে দাসত্বের শৃংখলে বন্দী কিনা বা কেন, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ঔপোন্যাসিক। এর পাশাপাশি তলকুঠুরির গানের সবচেয়ে উজ্জ্বলতা ও সফলতা এর মূল দুই চরিত্র মুনিরা আর শরিফউদ্দিনের মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত, দাম্পত্য, এদের যার যার অতীত ও বর্তমানের বোঝাপড়া। থাকেনা কিছু বই, পাঠান্তে যে কোন পাঠক তার যাপিত জীবনের দিকে আঙুল তুলতে বাধ্য হন।সাম্প্রতিক বছরে এদেশে রচিত হওয়া উপন্যাসগুলোর মাঝে তলকুঠুরির গান শক্তিশালি একটি সংযোজন।
বিস্ময়টা এখানেই, হুট করে রিশাদ ভাই মারফত এ বই চোখে না পড়লে আজও পাঠের বাইরে থেকে যেত। যতটা আগ্রহ পাঠকের থেকে ‘তলকুঠুরির গান’ দাবি করে, তার বিন্দুমাত্রও কি পেয়েছে? বিস্ময়ের দ্বিতীয় কারণ, এমন জটিল বিষয় নিয়ে লেখা বই, ভাষা কত সরল, কত গতিময়! নিউইয়র্ক টাইমসের রিভিউ লিখতে হলে আমি এ বই সম্পর্কে বলতাম, ‘Easily accessible but profoundly complex’!
বোর্হেসের সেভেন নাইটস পড়ছি কয়েকদিন ধরে, বিভিন্ন সময়ে দেয়া তার সাতটি বক্তৃতার সংকলন। মধ্যপঞ্চাশেই তিনি অন্ধ এবং চলাফেরা করছেন মা’কে নিয়ে–জননী ছাড়া যাতায়াত, পড়ালেখা অচল। বলছেন লেখকের তাৎক্ষণিক চিন্তাভাবনা অতোটা গুরুত্বপূর্ণ না যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার কাজ অর্থাৎ লেখাগুলো। কোলকাতার এবং মুশায়েরা থেকে বের হওয়া অনুবাদ, ভাল নয় খুব–কাজ চলার মত।
মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরবর্তি সময়ের রেশটা ধরা হয়েছে দ্বিতীয় দিনের কাহিনীতে। স্বাধীনতা সাধারণ জনগণকে আসলেই ছুঁয়ে গেছে কিনা, গেলেও কতটা, জীবনের গুঢ় অর্থের প্রতি মানুষের আগ্রহই বা কতটুকু? পাতায় পাতায় এই জিজ্ঞাসার ছেঁড়া তারে লেখক যেন ছড়া ঘষে গেছেন। যুদ্ধ শেষেও জলেশ্বরীকে অস্ত্র হাতে পাহারা দিয়ে চলেছে একদল মুক্তিযোদ্ধা, তাদের কাছে যুদ্ধটা যেনবা শেষ হয়নি তাই তারা জমা দেয়নি অস্ত্র। মূল চরিত্র তাহের, যার স্ত্রী পাক হানাদের হাতে লাঞ্চিত ও মৃত, ফিরে এসেছে নিজের জন্মস্থানে। তার চোখ দিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশের নিদারুণ হতাশার ছবি এঁকেছেন সৈয়দ শামসুল হক। প্রথম যখন হাতে উঠাই, টানা গদ্য দেখে একটু পিছিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি, এমন গদ্যকে শুধু দারুণ বললে সুবিচার হচ্ছেনা। বলতে হবে ঋজু, সুখপাঠ্য, নিরাবেগ এবং পেজ টার্নার। তিনঘন্টার বেশি লাগেনি ১২০ পাতার বইটা শেষ করতে। পাঠান্তে বুকের ভিতর ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, চোখে জল আসবে, এমন ইমোশনাল অরকেস্ট্রাও বাজেনা কোথাও। কিন্তু এ উপন্যাস শেষ করে যত সময় গড়াচ্ছে, বইয়ের বক্তব্য চেপে বসছে মগজে, যে বক্তব্য আজকের বাংলাদেশের জন্যেও সমান প্রাসঙ্গিক। সৈয়দ শামসুল হক, প্রণতি জানবেন মায়েস্ত্রো।
স্বপ্ন আর বাস্তবতায় পাক খেতে থাকা একটা হাওয়ার ঘূর্ণি স্বপ্নবন্দী’র মূল চরিত্র। নিজের চাওয়া ও তার থেকে পলায়ন কিংবা নিজেকে ভেঙে নিয়তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাওয়া–এই নিয়ে তৈয়ার হয়েছে আখ্যান। চরিত্র নির্মাণ আর কাহিনীর বিন্যাসের কারণে ৮৬ পৃষ্ঠার বইটিকে আমি নভেলা বা ঔপোন্যাসিকা বলবো। ঘন্টা তিনেক লেগেছে শেষ করতে, সে হিসেবে পেজ টার্নার বলা যেতে পারে আবার একইসঙ্গে এটা বইয়ের একটা দুর্বলতাও, খানিকটা স্থির ও ধীর পরিসরে বলা চলতো কোন কোন যায়গায়, ওতে সমস্ত কিছু আরও পোক্ত হত। আঙ্গিকে ভিন্নপথ নেবার প্রচেষ্টাটি প্লটের হিসেবে সার্থক।
সতীর্থ আখতার মাহমুদকে সাধুবাদ। আপনার লেখার হাতটি আরও মজবুতি যেন পায়।
শাহাদুজ্জামানের কেঁদো বাঘের গল্প পড়লাম। খেলাচ্ছলে রূপকথা, রূপকথার সরস ভঙ্গিমায় পিতা ও কন্যার চিরন্তন ট্র্যাজেডী। গল্পটার নাম- তারপর যেতে যেতে। এমন শীতের দুপুরে যখন কর্মস্থল থেকে নিয়েছি ছুটি, শরীরের সঙ্গে দুর্বল হয়ে উঠছে কনসাশনেস, সেই মানুষ থেকে বাঘ হয়ে যাওয়া বাবাটির জন্য মন কেমন করছে।
কিছু বই পাঠের পর বিপন্ন লাগে। শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সেরকম একটা বই। বদু মওলানারা আজিজ পাঠানদের আশ্রয়েই আবার পুনরুত্থিত হয়, আর লক্ষীবাজারের আব্দুল মজিদ হয়ে ওঠে জীবন হাতে পলাতক সকল আম জনতার প্রতিনিধি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি এই বাস্তবতা কঠোর হয়েই বাংলাদেশের হৃদয়ে ঘা মারছে আজও। মাত্র ৫৩ পৃষ্ঠার পরিসরে জহির এক মহাকাব্যই লিখতে পেরেছেন। বিষয় ও পরিমিতি বিবেচনায় এর সঙ্গে তুলনীয় বই বিশ্বসাহিত্যে বিরল।
বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ চরিত্রটির নাম হোসেন। বিষাদসিন্ধু পাঠের বড় পাওয়া হয়ত এমন একটা চরিত্র আবিষ্কার। ঐতিহাসিক ত্রুটি ছাপিয়ে এ উপন্যাস শুধু গল্পের মোহে পড়ে ফেলা যায়, প্রকাশের এই একশ বছর পরেও। এক সার্থক এপিক, সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে হাই ফ্যান্টাসির বিবিধ উপাদান। মীর মশাররফের ভাষাও অতুলনীয়, একই সঙ্গে ক্লাসিকাল মিউজিকের স্বাদ দেয়, সহজ পাঠেও ক্লান্তিহীন।
হুমায়ূন আহমেদের নভেলা ‘১৯৭১’ পড়লাম। একে বড় গল্পও বলা যেতে পারে।
১টা প্রত্যন্ত গ্রামে আচমকা ঢুকে পড়ে ১দল মিলিটারি, নিকটস্থ জঙ্গলে লুকিয়ে আছে কিছু মুক্তিবাহিনী–এইরকম সংবাদ পেয়েই তারা গ্রামে আসে। ১দিনের কাহিনী, ১টা ভোর থেকে দিন পেরিয়ে রাত নামা অব্দি। এ ব্যপ্তিতে মিলিটারিরা গ্রামের বিশিষ্ট লোকজনকে জেরা করে, কয়েকটি ধর্ষণ ও হত্যা করে–গ্রামের এক প্রান্তে কৈবর্তপাড়াটি জ্বালিয়ে দেয়। যুদ্ধের গল্পে এ আর নতুন কী? পাকিস্তানী মেজর মানেই বুদ্ধিহীন কিলিং মেশিন এমন না। তার বিবেচনাবোধ আছে। গ্রামের লোকজনকে জেরা করে যখন সে কিছুই প্রায় বের করতে পারেনা, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটা দৃশ্যকল্পের কথা: এমন যদি হত, বাঙালি মিলিটারিরাও পাকিস্তানী একটা গ্রামে এইভাবে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা কি নিষ্ঠুরতা দেখাতোনা? প্রশ্নগুলো সে করে বাঙালি সহচর রফিককে। মানে নিজের মাঝে কাজ করা অপরাধবোধ মেজর এজাজ এইভাবে এড়াতে চায়।
আখ্যানটির দেহে আরোপিত কিছু নেই, তবু মেজর এজাজের চরিত্রটি ঘৃণ্য এবং তার দোসর রফিকের চরিত্রটি হয়ে ওঠে মহৎ–অথচ সে তো রাজাকার। কীভাবে এবং কেন? ১৯৭১’কে হুমায়ূনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলেই মনে হল।
আত্মজীবনী কেন পড়ি? একজন মানুষ যা যাপন করলেন নিজের দেশ-কাল-সন্ততির মাঝে, রূপকে নয়, সরাসরি নিজের নিত্যবস্তু আর প্রাণে, সেই অভিজ্ঞতা নিতে। দ্বিজেন শর্মার ‘জীবনস্মৃতি : মধুময় পৃথিবীর ধুলি’ পাঠান্তে কেমন এক শান্ত সমাহিত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। এই মানুষটি নানান কারণে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গাছপালা নিয়ে এরকম মগ্ন জীবন আমাদের মাঝে আর কে কাটিয়েছেন? পৃথিবীর যে প্রান্তে গেছেন, থাকতে চেয়েছেন বৃক্ষের সঙ্গে। এজন্যই হয়ত তিনি বৃক্ষের মতন নির্বিকার, সাতচল্লিশের দিনগুলোতে, ৭১ সনে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক খৃষ্টান পল্লীতে লুকিয়ে থাকার সময়েও মজে আছেন প্রকৃতির স্নিগ্ধতায়–অথচ প্রাণ ওষ্ঠাগত, স্ত্রী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, জীবন হাতে নিয়ে দেশত্যাগ করছেন তবু পৃথিবীকে দেখছেন অবাক চোখে! আর যা মেলে, সোভিয়েত রাশিয়ায় কাটানো তার অনুবাদক জীবনের আনন্দ-হতাশা, স্মৃতি ও পরবর্তিকালের নষ্টালজিয়া। তিনটি দেশ ভেঙে পড়ার সাক্ষী এই মানুষটি, এবং মনে হয় যে তার বেদনার অধিক যায়গা দখল করে নিয়েছিল শেষোক্ত ভাঙন–সোভিয়েত রাশিয়ার পতন। কমিউনিজমের প্রতি অন্ধ আনুগত্য তার ছিলনা, সমালোচনা ও শ্রদ্ধার মিশ্রণেই এই সমাজ কাঠামোকে তিনি ভালবেসেছেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পরেও বারবার তাই মস্কোতে ফিরেছেন সে দেশকে দেখতে। এছাড়া বাংলাদেশ, এর শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তার কিছু মন্তব্য বিশ্লেষণ গুরুত্ববহ মনে হয়েছে। এসব ছাড়া বইটি কেমন? এত মোহনীয় গদ্য, নরম করে যেন জড়িয়ে ধরে, শোনা কথায় যেমন শুনেছি মানুষ হিসেবে যেমন মোলায়েম ও ধ্যানী ছিলেন, তার গল্প করবার ধরণটিও সেরকম, অবিকল। এ বই কি অবশ্যপাঠ্য? জীবন আর প্রকৃতি নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, এ বই তারা আদতে গিলবেন।
একজন নারীলিপ্সু পুরুষ, যে পছন্দ করে কেবল উঠতি বয়সি তরুণীদের। প্রেম বলতে যে বোঝে শুধুই শরীর–এজন্য সে নিত্যই একটা বদলের চেইনে দিন পার করে। এক নারী থেকে আরেক নারীতে ভ্রমণটাকে তার মনে হয় প্রকৃত জীবন। মোটাদাগে এই হল সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা’র কাহিনী। কিন্তু উপন্যাসের যে খেলাটা, এ কি মোটা দাগের? বিশ্বসাহিত্যের সার্থক উপন্যাসগুলো সব সময় গল্পের আড়ালে গল্প বলে, বক্তব্যের আড়ালে থাকে আবিষ্কার করতে পারা যাবে এমন অনেক বক্তব্য।
উপন্যাসটির মূল চরিত্র বাবরের মনোজগত নিয়ে ভাবতে শুরু করলে সমাজের জান্তব একটা দিকের বর্ণনা মিলে যায়, অনেকের মাঝে একের সুষমা যেন বাবর। তার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের প্রতি বিদ্রূপাত্মক, মধ্যবিত্তের পোশাকি ভদ্দরলোকির পানে সে সব সময় আঙুল দেগে রাখে, অনবরত নারীসঙ্গ বদল তার জীবনে কোনরকম অপরাধবোধ তৈরি করেনা। সে আত্মপ্রসংশা পছন্দ করে কিন্তু একইসঙ্গে কেউ আত্মপ্রচার করলে ওতে বিরক্ত হয়, কারও উপকার সে করলে অন্যপক্ষের বিনয়টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। নারীর ক্ষেত্রে তার আকর্ষণ একেবারে চাঁছাছোলা শারিরীক হলেও নিজেকে সে মনে করে প্রেমিক–ভাড়া করা নারীতে তার আগ্রহ রয়না, নারী তার কাছে শিকার করবার বস্তু। পাশাপাশি অতীতের এক সুগভীর পাপের তাড়না বাবরের মজ্জাগত; বারংবার সে এই ট্রমা থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করে নাকি এ ট্রমাই একজন পরাজিত মানুষ হিসেবে তার প্রকৃত চিহ্ন যা উপন্যাসের শেষে তাকে একজন যোদ্ধায় পরিণত করে?
এবং আঙ্গিক; শাখা প্রশাখা বিস্তারের চে’ উপন্যাসটির দীর্ঘ দেহ শুধু যেন মূল চরিত্র বাবরের প্রতিই বিশ্বস্ত ছিল। এ আখ্যানটির নারীগণ কি আমাদের পরিচিত? উঠতি বয়সি তরুণীদের ভাবালুতা এবং মনস্তাত্ত্বিক বাঁক বদলের দিকগুলো বড় সুস্থির মগ্নতায় ফুটে উঠেছে। একই সঙ্গে ষাটের দশকের টিভিপাড়ার টুকরো ছবি কিংবা ঢাকা মহানগর। শুধুমাত্র একজন পুরুষের যৌন অভিজ্ঞতার গল্প নয়, এখানে যৌনতা স্রেফ একটা টুলস, বাবরের অভিজ্ঞতার গহনে যে বক্তব্য, মানব সমাজের প্রতি তা আমাদের এক ভিন্ন দৃষ্টি ফেলতে আহ্বান জানায়।
পাঠান্তে খেলারাম খেলে যা পাঠককে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিতে পারে, ভাবিয়ে তুলতে পারে, শেষ করবার পরেও মগজের পর্দায় দুলতে পারে বাবরের বিচিত্র জীবনের রেশ, এ বড় গহীন ক্ষমতা যে কোন বইয়ের পক্ষে। খেলারাম মাস্টারপিস।
এর আগে পড়েছিলাম নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি। গল্পকার সোমেন চন্দের মৃত্যু থেকে মুনির চৌধুরীর সম্ভাবনা, ঐ সময়টার বিষণ্ণ বারুদগন্ধি আখ্যান। এদ্দিনপর পুনরায় সেলিনা হোসেন পড়ছি। যাপিত জীবন। প্রথম অধ্যায়, দেশভাগে বহরমপুর থেকে বাংলাদেশে চলে আসা একটি পরিবারের পিতা যখন বলেন, এ দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার খাতিরে–তখন খুবই আরোপিত মনে হল লাইনটিকে। অথচ কিছুদিনবাদে একই মানুষ যখন স্ত্রীর সাথে আলাপে ভাবেন, দেশভাগের ফলে এই যে পরবাস–আবার কি এ দেশটাও ভাগ হয়ে যাবে? ৪৭ সনের প্রেক্ষাপটে এ লাইন পড়ে চমকে উঠতে হয়, যাপিত জীবনে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় এখান থেকেই।