মনের আনন্দে গান গাইত সেই মেয়ে। অল্প লোকে শুনত। কিন্নরীদের মত কন্ঠ। গান ছাড়া আর কিছু করতে তার ভাল লাগতনা। অল্প লোকে শুনত। ছোট কাফে। প্রতি সন্ধ্যায় জমে যেত আসর।
এক সময় ছোট্ট শহরের সব কাফেতেই কোন না কোন সন্ধ্যায় দেখা মিলত তার। কনসার্টে, কার্নিভালেও। শীতের বাতাসে, গ্রীস্মের হাওয়ায়, বসন্তে পাতার মর্মরে শুধু যেন তার বিষণ্ণ গভীর সুরেলা কন্ঠ।
মানুষ তাকে ভালবাসল। এতই ভালবাসা যে নিজেদের শহরটিকে তারা বলত গানের পাখির শহর। যেন তারাও পাখির মত, আর রাণী পাখির জন্য তাদের সমস্ত কাজকর্ম।
সবাই জানত, এই মেয়েটি, এই গানের পাখি শুধু তাদের হয়ে থাকবেনা আর। দ্রুতই তার কন্ঠ ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে। অতঃপর সারা পৃথিবীতে। মানুষ বলবে এই পৃথিবীতে আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকা আনন্দের, কেননা আমাদের জন্য এক মেয়ে এমন গান গায় যার কন্ঠ ঋতুচক্রের সমস্ত আকাশকে স্পর্শ করে, যে দুঃখী তার সমব্যাথি হয়, সুখী যে জন তার সুখকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়।
কিন্তু পৃথিবী তো নিষ্ঠুর করুণ। সে নিজেই নিজেকে ক্লান্ত কন্ঠে বলে, “নিখুত কোন কিছুই আমার নয়। সম্পূর্ণ যা কিছু, কোন অধিকারেই বা তাকে ধরে রাখব আমি? পথভুলে যে চলে এসেছে আমার বুকে, পথভুলেই সে অকস্মাৎ চলে যাবে, এই নিয়ম আমার জন্য সময় লিখে রেখেছে।”
তাই এক শরতের অবসরে গানের পাখির পিঠে দুটি আশ্চর্য ক্ষত আবিস্কার করল চিকিৎসকেরা। মেয়েটি অবাক হয়ে বলল যে গতরাতেও তার কাছে এই চিহ্ন ছিলনা। এমন ক্ষত, এমন কোন বেদনা ছিলনা। আকাশে চাঁদ ছিল। বন্ধুদের সঙ্গ ছিল। বিছানার চারপাশে চিঠি আর চিরকুটের শুভ্র টিলা ছিল।
হাসপাতালের বিছানায় উপুড় করে শুইয়ে রাখা হল তাকে। আর রাতের শেষ প্রহরে পিঠের ক্ষতস্থান থেকে দুটি বিশাল ডানা গজালো তার। চিকিৎসকেরা বুঝতে পারলেন না ঠিক কী হচ্ছে। যদিও মেয়েটি বুঝে নিল শরত ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাকেও বসন্তের দিকে উড়ে যেতে হবে। সে তার শেষ গানটা গাওয়ার আগে চিকিৎসকদের বলল জানালাটা খুলে দিতে।
শহরের সবচেয়ে উঁচু জানালা। গ্রীলবিহীন। জীবনের শেষ গানটা গাইল গানের পাখি। হাসপাতালের লবি, শহরের সব রাস্তা, মানুষের ঘুমন্ত বিছানা, আর খোলা মাঠের লম্বা ঘাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার কন্ঠ মিশে গেল পৃথবীর সমস্ত নদীর জলে।
জীবনের তেত্রিশতম হেমন্তে সে তার বিশাল ডানা হাওয়ায় মেলে ধরল। উড়ে গেল চিরতরে।
কিন্তু তার উড়ালের পরেও, অনেক দিন রাত্রি পার হলেও, শোকের কালো রেখা মুছে গেলেও শহরের মানুষেরা আশ্চর্য হয়ে আবিস্কার করল: আনন্দ রয়ে গেছে কোথাও। পৃথিবী সেই মেয়েটিকে ধরে রাখতে না পারলেও বাতাস তার কন্ঠকে ধরে রেখেছে, কান পাতলেই সেই আশ্চর্য গান আজও শোনা যায় –
Since you went away the days grow long
And soon I’ll hear old winter’s song
But I miss you most of all my darling
When autumn leaves start to fall
পাদটিকা
কখনও কখনও এমন হয়, অনবরত গান শুনতে থাকি ইউটিউবে। এবং গানের সাজেশন তৈরি হয় কোন গানটা প্রথম প্লে করেছিলাম সেটার উপরে। গত শীতের এক রাতে জন ডেনভারের জেনিস সং থেকে শুরু করে লানা দেল রের শেডস অফ কুল, ন্যান্সি সিনাত্রার ব্যাং ব্যাং থেকে বব ডিলানের আ হার্ড রেইন গনা ফল, এভাবে চলছিল। তারপর এসবের মাঝেই এলো অটাম লিভস। হেমন্তে পাতা ঝরে যাচ্ছে কারও জানালার ওপাশে, আর তার মনে পড়ছে প্রিয়তমের কথা। যে চলে গেছে জীবন থেকে, আর দীর্ঘ করে দিয়ে গেছে দিন রাত। এত বিষণ্ণ গানের কথা, আর যে শিল্পী গাচ্ছে তার এমন নিটোল হাহাকার জাগানো কণ্ঠ – আমি নড়েচড়ে বসলাম।
ঠিক যেভাবে ২০১৫ সালে আমি আবিস্কার করেছিলাম লানা দেল রে’কে তার ইয়াং এন্ড বিউটিফুলে, তারও বছর পাঁচেক পর এভাবেই আমি ইভা কাসিডিকে খুঁজে পেলাম অটাম লিভসে। সে আমার রোজকার প্লে লিস্টে ঢুকে গেলে। আমার চিন্তায়, আমার হৃদয়ে। কিন্তু তার জীবনের গল্প খুঁজতে গিয়ে আমি হারিয়ে যাওয়া এক নক্ষত্রের ইতিহাসই পেলাম।
ইভার জন্ম ১৯৬৩ সালে। ইউ এস ওয়াশিংটন ডিসির ম্যারিল্যান্ডে। তার জন্ম শহরের নাম অক্সন হিল। ফোক, জ্যাজ, ব্লুজ এসবের একটা মিশ্রণ তার গানগুলোয় মেলে। আর তার বিশেষ ধরণের গানের গলাটিকে বলা হয় সোপরানো। যে কণ্ঠ আসলেই ঋতুচক্রের সমস্ত আকাশকে ছুঁয়ে দিতে পারে, এত বিস্তৃত এর রেঞ্জ।
ম্যারিল্যান্ড আর সব মিলিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির বাইরে তার পরিচিতি ছিলনা জীবদ্দশায়, কিন্তু সবাই জানত খুব বেশি সময় লাগবেনা ইভার বিখ্যাত হতে আর। কনসার্ট করছিলেন নিয়মিত, ছোট ছোট ট্যুর, এলবামগুলো মানুষ শুনছিল দারুণ ভালবাসায়। কিন্তু গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ার আগেই তার শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়ংকর মেলানোমা। চামড়া থেকে শুরু হয়ে যা মানবদেহের হাড় অব্দি ধ্বংস করে। ১৯৯৬ সালে এই স্কিন ক্যানসারে তার মৃত্যু হয়। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে।
বেঁচে থাকতে তার এলবাম মাত্র দুটি। চাক ব্রাউনের সাথে ডুয়েট দি আদার সাইড (১৯৯২)। এবং যে বছরের হেমন্তে মারা যাবেন, সেই ১৯৯৬ এর মে’তে প্রকাশিত লাইভ অ্যাাট ব্লুজ এলাই।
ব্লুজ এলাই ছিল সেই বিখ্যাত জ্যাজ নাইট ক্লাব যেখানে ইভা সব সময় করতেন। শহরের মানুষেরা দলবেঁধে শুনতে আসত গানের পাখির গলা। মৃত্যুর দু’বছর পর তার অপ্রকাশিত রেকর্ডিংস আর এই ব্লুজ এলাইয়ে শুট করা কিছু ভিডিও নিয়ে প্রকাশিত হয় ইভার শেষ এলবাম সংবার্ড।
নিজ শহর বাদে পৃথিবীর আর সব মানুষেরা ইভার কন্ঠ শোনার সুযোগ পেয়েছিল শুধু তখনই, যখন সে চলে গেছে অনেক দূর, আর তাদের দিনগুলো হয়ে উঠেছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরো।