রবোকপের চোখে আমরা যা দেখতে পাব

robocop mix

পপ কালচার অনেক কারণে গুরুত্ববহ। তবে এ লেখায় পপ কালচারের একটি বিশেষ দিক নিয়ে আমি আলাপ করতে চাই। তা হল আর্টে জনপ্রিয় উপাদানের ব্যবহার। এইটা করতে গিয়ে আর্টিস্ট অনেক সময় সোশাল স্যাটায়ার করতে পারেন, গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্রিটিসিজম সেরে নিতে পারেন। এমনকি আলাদা কোন ইনটেনশন না থাকা সত্ত্বেও এই ক্রিটিক বা বিদ্রুপের ঘটনাগুলো সাহিত্যে, চিত্রকর্মে, গানে বা সিনেমায় খুব সার্থকভাবে উপস্থাপিত হয়ে যেতে পারে।

বিশেষ করে এই দিকটা আমি নতুন করে উপলব্ধি করলাম সম্প্রতি পল ভারহোভেন নির্মিত রবোকপ (১৯৮৭) রিওয়াচ করতে গিয়ে। আমরা যারা নাইনটিজের সন্তান, আশির দশকের এই হলিউডি সিনেমা প্রথম দেখেছিলাম সিরিজ আকারে। মূল সিনেমার আলাপে যাওয়ার আগে ছোট্ট এক স্মৃতিচারণ আমি করে নিচ্ছি। নিজের অসচেতন বয়সের একটা ঘটনার সঙ্গে যা এই লেখার মূল বিষয়কে যুক্ত করতে পারবে বলে মনে হয়।

বিটিভিতে রবোকপ হত তখন রবিবারে। তাকে খুবই পছন্দ করতাম। সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম প্রতি পর্বের জন্য। যাকে বলে রবোকপ ম্যানিয়া। দুই টাকা দামের খাতায় রবোকপ, চকোলেটের সাথে পাওয়া স্টিকার বা চিউয়িংগামে রবোকপ। কল্পিত খেলায় নিজেকে এই সাইবর্গের মত করে ভেবে নিয়ে হাত-পা ভেঙে ভেঙে হাঁটাচলা, মেকানিকাল কন্ঠস্বর নকল করে কথা বলা।

সে সময় মনে আছে, তোফায়েল আহমেদ ছিলেন অর্থমন্ত্রী। উনি টাক ছিলেন। এবং সেটা নিয়ে আমরা শিশুরা বেশ অমানবিক একটা ঠাট্টা তামাসা করতাম। আবার তখন ক্রিকেটেও বাংলাদেশের উত্থান হয়েছে। আইসিসি ট্রফি জয়ের পরবর্তি সময়। রবোকপ যেমন দেখি, ক্রিকেট পছন্দ করি, তোফায়েল আহমেদও আমাদের চর্চার বিষয়। সব মিলিয়ে আমি খাতার পৃষ্ঠা ভরে এক আশ্চর্য কার্টুন বা ক্যারিকেচার আঁকতে শুরু করেছিলাম। যার মাথাটা তোফায়েল আহমেদের, বডি আর্মর ও হাত রবোকপের, পায়ে আবার ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা যে প্যাড পরে সেই প্যাড।

সব মিলিয়ে এখন চিন্তা করতে বসলে এই অসচেতন আঁকিবুকির অনেক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাবে। যেমন অর্থমন্ত্রী হিসেবে তোফায়েল আহমেদের কাজকর্ম একটা ক্যারিকেচার ছিল কিনা, বা ক্রিকেটে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রাণহীন তথা রবোটিক হয়ে দাঁড়াবে কিনা। একজন শিশুর মনে এত গভীর কিছু খেলা করেনা, করার কথাও নয়। কিন্তু খুব জনপ্রিয় উপাদান দিয়ে সে যা তৈরি করল, সেটা থেকে স্যাটায়ারের আভাস মিলতে পারে।

যাই হোক, এবার আমরা মূল সিনেমার আলাপে যেতে পারি।

রবোকপ এর পটভূমি আমেরিকার ডেট্রয়েট অঙ্গরাজ্যের এক কল্পিত শহর ডেল্টা। বিশৃংখলা যে শহরে মাত্রা ছাড়াচ্ছে দিনের পর দিন। ক্রাইমের পরিমাণ বেড়ে গেছে। মানুষ যত্রতত্র ডাকাতি বা খুন করছে। রেপ, অপহরণ, ড্রাগের প্রসার লিমিটলেস। এসব সামলাতে পুলিশের করুণ অবস্থা। এদের অস্ত্র প্রিমিটিভ। সন্ত্রাসীদের ভারি অস্ত্র ও গাড়ির তুলনায় পুলিশের অবস্থা খুবই নাজুক। প্রায়ই সন্ত্রাসীদের সাথে গানফাইটে মারা যায় বহু পুলিশ অফিসার। এসবের মাঝখানেই শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাপনা, নির্মাণ, রাজনীতি সব কিছুর উপরেই প্রভাব বিস্তার করছে ওসিপি বা অমনিকর্প নামের এক প্রাইভেট কোম্পানী।

এমন পরিস্থিতিতেই রবোকপের আবির্ভাব ঘটে শহরে। গানফাইটে মৃত পুলিশ অফিসার অ্যাালেক্স মার্ফির মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে অত্যাধুনিক এক সাইবর্গ বানায় অমনিকর্প। যে আধেক মানব, আধেক রোবট। যাকে একজন ল’এনফোর্সমেন্ট অফিসার হিসেবে নির্মাণ করা হয়। এর পেছনে অমনিকর্পের মূল উদ্দেশ্য থাকে যে, চুড়ান্ত এক ডিস্টোপিয়ায় মানুষের ফাইটিং স্পিরিটকেও তারা নিজেদের দখলে নেবে, আইনের প্রয়োগও চলে আসবে কোম্পানীর নিয়ন্ত্রনে।

মূল গল্প নিয়ে আলাপ করবোনা আর। আমার লক্ষ্য হচ্ছে পুরো সিনেমায় কীভাবে রবোকপ বা সাইবর্গের মত একটা জনপ্রিয় উপাদানকে কাজে লাগিয়ে অনেক সামাজিক ইস্যুকে কানেক্ট করতে চেষ্টা করা হয়েছে, সেসব পয়েন্ট আউট করা।

প্রথমত, এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে প্রাইভেটাইজেশনের সম্ভাব্য চেহারা। আমেরিকা কীভাবে জনগণের রাষ্ট্র থেকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পত্তিতে পরিণত হতে পারে, কীভাবে প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেশনগুলো মানুষের নাগরিক অধিকার ও সুযোগ সুবিধার দখল নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারে, এসব ব্যাপারের প্রায় সরাসরি বিদ্রুপ আছে অমনিকর্পের কাজকর্মে।

একটা শহরে ক্রাইম ওয়েভ বাড়তে থাকলে সেখানে প্রশাসন ও বিজনেস জায়ান্টগুলোর ভূমিকা কী? বা এর পেছনের কারণগুলো কী কী হতে পারে? এই দিকটা গল্পে টুইস্ট হিসেবে আসলেও অনেক দৃশ্যেই প্রচ্ছন্নভাবে তা দেখানো হচ্ছিল। স্বয়ং রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, কেন তখন কেওস বেড়ে যায়? এই প্রশ্নের এক্সিকিউশন আছে রবোকপের বিভিন্ন অধ্যায়ে।

অনেকে রবোকপের আলোচনায় মেরি শেলির ফ্র্যাংকেনস্টাইনের রেফারেন্স নিয়ে আলাপ করেন। এই আলাপ ঠিক আছে তবে একটু অন্যভাবে। ফ্র্যাংকেনস্টাইন সৃষ্টি করে এক দানব। আর দানবের ইমোশন কাল হয়ে দাঁড়ায় তার স্রষ্টা ও আপনজনদের জন্য।

স্রষ্টার ডিলেমা ও সৃষ্টির বেদনা, ফ্রাংকেনস্টাইনের এই থিমের রগরগে চেহারা দেখি আমরা রবোকপে। সে প্রকৃতপক্ষে স্টিম্পপাংক যুগের মডার্ন প্রমিথিউস। স্রষ্টার ঔৎসুক্য থেকে তার জন্ম না। তার জন্ম স্রষ্টার ক্ষমতা বিস্তারের লোভ থেকে। কিন্তু দানবীয় মেশিনারিজের ভিতরে বন্দী হয়ে পড়া এলেক্স মার্ফির মস্তিষ্ক তো একজন সৎ, নির্ভিক, দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারের।

সুতরাং অমনিকর্পের উদ্দেশ্য রবোকপ যত না পূরণ করে, তারচেয়েও বেশি সে হয়ে ওঠে একজন নায়ক। প্রমিথিউসের মতই সে আগুন নিয়ে আসতে চায় মানুষের জন্য। ডিস্টোপিয়ান ডেল্টা শহরটিতে সে চায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। এ কারণেই আমরা দেখি: নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যারা রবোকপের সৃষ্টি করেছিল, ওরাই সমান উদ্যমে তাকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়।

যন্ত্রের দেহে আঁটকে পড়া মানুষের অসহায়তারও এক মেটাফোরিকাল উপস্থাপনা রবোকপ। সে জানে তার একটা জীবন ছিল, সংসার ছিল। ওসব সে ভুলতে পারেনা। কিন্তু চাইলেও সে মেশিনারিজ ছাড়া সার্ভাইবও করতে পারবেনা। এই বিষয়টি খুব দ্রুত বদলে যেতে থাকা যন্ত্রনির্ভর জীবনকে কীভাবে কানেক্ট করেছিল সে যুগে, সিনেমাটি মুক্তির তিন দশক পর আমাদের আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়বেনা।

পাশাপাশি, আমেরিকান অস্ত্র আইন জনজীবনের জন্য নিরাপদ নাকি ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতার উপায় হয়ে উঠতে পারে যে কোন সময়, এ প্রশ্নও খুব সার্থকভাবে করতে পেরেছিল এই সাইফাই সিনেমা। এ ব্যাপারটি আজও কতটা সমসাময়িক, তা বুঝে উঠতে আমরা পিউ রিসার্চের একটা ডেটার দিকে লক্ষ্য করতে পারি। ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে ওরা ২০১৭ সালের একটা এস্টিমেশন প্রকাশ করেছিল। যেখানে দেখা যায় যে, গান ভায়োলেন্সের শিকার হয়ে সে বছর ৩৯,৭৭৩ জন মানুষ মারা গিয়েছিল (২০২০ সালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৫,২২২ জনে)। নোটেড কারণগুলোর মাঝে ছিল হত্যাকান্ড, সুইসাইড, দুই তিনজন একসাথে গোলাগুলিতে যুক্ত হওয়া।

খালি চোখে দেখলে হয়ত অজস্র মৃত্যু, সীমাহীন নৃশংসতা, আর টানটান একশনে ভরপুর এক এডাল্ট সুপারহিরো ফ্লিক এটা। কিন্তু একটু মনযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায় রবোকপের ছদ্মবেশে কত জটিল সব বিষয়বস্তুর দিকে আলো ফেলেছে এই সিনেমা।

যদিও আমার মনে হয়না পল ভারহোভেন বা এই সিনেমার দুই লেখক এডওয়ার্ড নুমেইয়ার ও মিকায়েল মাইনার এত সব চিন্তাভাবনা করে এই সিনেমা বানিয়েছিলেন। ভারহোভেনের ক্যারিয়ারগ্রাফে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আরও অনেক রকমের পপ ইলিমেন্ট ব্যবহার করা সিনেমা আছে, সেগুলোর এক্সিকিউশন যেমনি হোক, যতই তারা উপভোগ্য বা বিরক্তিকর হোক, সোশাল ক্রিটিসিজম ও স্যাটায়ারে রবোকপের সাফল্য আনটাচেবল হয়ে আছে।

সে কারনেই আমার মনে হয়, জনপ্রিয় ধারার শিল্পকর্মকে শুধু কনভেনশনাল দৃষ্টিতে দেখলে চলেনা। যে কাজ প্রায় সব ধরণের জনগণ সাদরে গ্রহণ করে, কেন গ্রহণ করছে সেটা বুঝে ওঠা যে কোন মাধ্যমের শিল্পীর জন্যই জরুরি। আর্ট দিয়ে সমাজ বদলে দেয়া যায়না, কিন্তু আর্ট মানুষের চিন্তাধারা নির্মানে দারুণ প্রভাব রাখতে পারে। পপুলার আর্টের চর্চা যারা করেন তাদের লক্ষ্য হয়ত শুধু বিনোদনই উৎপাদনই হয়ে থাকবে। কিন্তু আপনি যদি আর্টের কাছে আরও কিছু চেয়ে থাকেন, এবং নিজেও এর আর কোন উপযোগিতা নির্মাণ করতে চান, পপ-কালচারের দিকে আপনাকে ফিরতে হবে অন্য এক রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

লেখাটা শেষ করব বাংলা সিনেমার ‘সুচিহ্নিত’ এক দুঃসময়ের কাল প্রসঙ্গে দুটি কথা বলে। অশ্লীল যুগ বা অন্ধকার যুগ হিসেবে একটা সময়কে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলা সিনেমার আধুনিক ইতিহাসে। আমাদের সিনেমার বর্তমান দুর্দশার পেছনে এই অন্ধকার যুগকে অনেকে দায়ি করে থাকেন। একজন একনিষ্ঠ সিনেমাভক্ত হিসেবে আমার ধারণা, এই অভিযোগে সত্য যদি বা কিছু থাকেও, অযুহাত খোঁজার চেষ্টা আছে আছে বেশি, এবং এই সময়টার দোহাই দিয়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সংলিষ্ট আরও অনেক রকম ব্যার্থতার গল্পকে চাপা দেওয়ারও একটা চল আছে।

১৯৯৭ থেকে ২০০৫ (তর্কসাপেক্ষে) পর্যন্ত যে সিনেমাগুলোকে অশ্লীল যুগের সিনেমা বলা হয়, এগুলো কোন দিক দিয়েই শিল্পোত্তীর্ণ সিনেমা নয়, বরং ক্লিশে, মেকি, বাজে অভিনয় ও বাজে পরিচালনার সম্ভার। ওসবের মূল পুঁজি ছিল দুটি পপুলার উপাদান, যথা – ভায়োলেন্স এবং যৌনতা। কিন্তু এসব সিনেমা যেভাবে ঐ সময়কালের রাজনীতির নোংরামো, সোশাল ডিজাস্টারগুলো প্রায় সরাসরি পোর্ট্রে করতে পেরেছিল, তা অতীতের আর কোন কালের বাংলা সিনেমাই মনে হয় পারেনাই। এটা ঐ অন্ধকার যুগের সাফল্য।

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন