ডায়নোসরের পিঠ

ডায়নোসরের পিঠ

The real voyage of discovery consists not in seeking new landscapes, but in having new eyes.

– The Prisoner, Marcel Proust

এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়া ডাকে নাই, তাদের কাছে এ পৃথিবী ধরা দেয় না কোনো কালেই।

– আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়

আমি আর ইসমাইল লঞ্চে উঠলাম। রঙবিহীন কাঠের লঞ্চ। মাঝেমধ্যে বিশাল ট্রলার বলে ভ্রম হয়। লঞ্চের কিনারায় বেঞ্চে বসে এক পাহাড়ী কিশোর এনার্জি ড্রিংক খাচ্ছিল। আমাদের মত দেখতে একজন লোক ওর সামনে দাঁড়াতে তরাসে উঠে যায়গা করে দিল বসবার। লোকটা হয়ত স্থানীয় বাজারে শুটকি বিক্রি করে, তার মত আরও যারা সেটেলার, সবাইকে পাহাড়ীদের তুলনায় বেশ প্রভাবশালী মনে হয়েছে এ কদিন।

ইসমাইলের লম্বা চুল দাড়িতে আকৃষ্ট হয়ে এক বিজিবি অফিসার তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল… আর সেইসব দিন নাই। পোলাপান বেয়াদপ হয়ে গেছে। ওনার এক মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ইত্যাদি বিষয়ক গল্প।

কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর লোকটা আমার সঙ্গে পরিচিত হল। কী করি জানতে চাইলে ইসমাইল বললো, ‘আমার বন্ধু। লেখক।’ তখন বিজিবি অফিসার কিছুক্ষণ চোখ ছোট করে আমাকে দেখে চিনে ফেলেছে রকমের ভঙ্গি করল। ‘আরে ভাই, আপনাকে তো টিভিতে দেখছি। আপনি টিভিতে প্রোগ্রাম করেন না?’

এই ধরণের পরিস্থিতিতে মুখের উপর কিছু বলা কঠিন হয়ে যায়। আমি বোকার মত হাসলাম।

ট্রলার খুব ধীরে ধীরে চলছে। দু’পাশে পাহাড়। নীলচে লেকের জল। ভাল বাতাস দিচ্ছে। রোদ নরম। ট্রলারে অনেক মানুষ। ইসমাইল বললো, ‘চা খাবা?’ আমরা কয়েকবার চা খেলাম। ছোট ছোট নৌকায় অনেকেই যে ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেদিকে যাচ্ছে। বাঙালি ছেলেমেয়ে। স্কুলে পড়ে।

এক সময় আমরা গন্তব্যে এসে গেলাম। এইখানে আর্মি ক্যাম্প। ঘাটে নেমে কোথায় যাব বুঝলাম না। ইসমাইল বললো, ‘শীত পড়তে ধরলেই ঝর্ণাগুলো শুকাইতে শুরু করে। আমরা আগামীবার বর্ষাকালে আসব।’ যদিও আমরা কেউই জানতাম না আর কখনও আসা হবে কিনা।

সিঁড়ি মত করা আছে একটা ছোট পাহাড়ে উঠবার জন্য। কিছুদূর উঠেই আমরা হাঁপিয়ে গেলাম, ‘পাহাড় ভাঙা খুব কষ্ট। আমার তো হাইট ফোবিয়া।’ ইসমাইল হাসল, ‘নিচে তাকাইয়া দেখো। কী সুন্দর। আল্লাহর চোখে পৃথিবী দেখার সুযোগ পাওয়া যায় পাহাড়ে উঠলে।’

‘এজন্যই সবাই এত পাহাড়ে ওঠে?’

‘হ। পাহাড়ে উঠে চুয়ানি খাইতেও মজা। একটা বোতল নিয়ে আসা দরকার ছিল। চলো নিচে গিয়া একটা বোতল নিয়া আসি। দাম কম তো এইখানে। চুয়ানি স্বস্তা মদ।’

মদের কথায় ইসমাইলের চেহারায় স্বর্গীয় আলো খেলা করে উঠলো। দুজনেই গরমে ঘামছি। অথচ হোটেলে যে বেজমেন্ট কামরা পেয়েছি আমরা, সেটা খুব ঠাণ্ডা। একটা সিগারেট ধরালো ও। সাধলো আমাকে। উদাস কণ্ঠে বললাম যে সিগারেট খেলে আমার গাল কষটা হয়ে যায়। খুব অস্বস্তিকর ব্যাপার।

কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর দুইজনে সিঁড়ি বেয়ে ছোট পাহাড় থেকে নেমে এলাম।  এক আর্মি অফিসার বলল, ‘আমাদের মিষ্টি খান। দামে কম। খুব ভাল মিষ্টি। আর কোথাও পাবেন না।’

সেনাকল্যাণের মাঝারি আকারের জেনারেল স্টোরে গিয়ে আমরা মিষ্টি কিনতে পারলামনা। শেষ হয়ে গেছে নাকি। আবার কাল সকালে আসবে। তাই আমরা কয়েকটা চম্পা কলা খেয়ে ফেললাম। ইসমাইল আর্মি দোকানদারকে বললো যে, ‘কাল সকালে তো আসতে পারবনা। কিন্তু এখানেই তো রাতে থেকে যেতে পারি। এই দোকানের বেঞ্চে ঘুমাইলাম ধরেন?’

আর্মি দোকানদার সন্দেহের চোখে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। কিছু বললোনা আর। ইসমাইলকে আমি ভবিষ্যতের কথা জানাতে পারলাম না। কেননা ভবিষ্যতে আরও এক পাহাড়ের চুড়ায় উঠে আর্মিদের তৈরি মিষ্টি খেতে গিয়ে তার কথা আমার মনে পড়েছিল। সৈন্যরা ভাল লোক আছে। মিষ্টি বানায়।

লেকের জলে হাতমুখ ধুতে আমরা সিঁড়ি বাধানো ঘাটে নেমে পড়লাম। এক লোক গোসল করছিল। বাঙালি। সে আমাদের বললো, ‘বাড়ির জুইন্যে মন কেমুন করে গো। মেলাদিন রইয়েছি ই পাহাড়ের দেসে। কাঠের কাম করি।’

টাকা পয়সা পান ভাল?

‘না।’

তাহলে থাকেন কেন?

‘পাহাড়ে রইয়েছি। ভালই যে লাগে।’

বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করেনা?

‘হেঁ করে। কিন্তু পাহাড়ে রইলাম। জীবনের একটা উভিজ্ঞতা হুইছে।’

ইসমাইলের স্বার্থে আমি লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে চুয়ানি পাওয়া যায়?’

‘হেঁ। বাজারে চুইলে যান। কাউরে বুইললেই আইনে দিবে।’

আমরা হোমসিক লোকটিকে পিছে ফেলে বাজারে পৌছলাম। চারপাঁচটা দোকানঅলা ছোট বাজার। একটাই হোটেল। সেখানে ছোট ছোট সিঙ্গাড়া। পেঁয়াজ মুখে দিয়ে খুব পানশা লাগে। হোটেলের মালিক খুব ডাব কাটতে চায়। ‘ভাইজান, পাহাড়ী ডাব। খাইয়া দেখেন। কাটি?’ ইসমাইল ডাব খেতে চাইল। কিন্তু আমি মানা করলাম। তখন লোকটা ডাবের উপরের অংশ কেটে ফেললো। আমরা দুজনেই খুব না না করলাম। আরও কয়েকটা সিঙ্গাড়া খেলাম। এরপর লোকটা জানতে চাইলো, ‘আমরা মাল খেতে চাই কিনা। ভাল জিনিস আছে।’ ইসমাইল বললো, ‘৫০০ এমেল দেন। টাকা বেশি নাই।’

আরও কিছুটা হেঁটে ভিতরে গেলে আমরা একটা টিনের মসজিদের দেখাও পেলাম। লেকের কিনার ঘেঁষে একটা পাকা উঠোনের মত। সেইখানে চেয়ারে বসে এক সেনা  অস্ত্র তাক করে আছে। ইসমাইল তাকে প্রশ্ন করলো, ‘ভাই গুলি হবে নাকি?’

স্বাস্থ্যবান তরুণ সেনা লাজুক হেসে বলে, ‘হবেনা। একটা ভাব নিচ্ছি আরকি। তবে রাতে খুব সাবধান। দস্যু আছে।’

বলেন কী?

‘হ্যাঁ রে ভাই। সেনাদের সব সময় এলার্ট থাকার নিয়ম। এখন অবশ্য মাছ আসবে।’

মাছ আসবে মানে?

কিছু সময় পরেই প্রমাণ পেলাম। মাছ এলো ছোট নৌকায়। বিশাল আকারের কয়েকটা কাতল। সেনা লোকটা কিছু নিচু কণ্ঠে বলে, ‘এই বড় মাছ ভাগে পাবোনা। বড় অফিসারের কোয়ার্টারে চলে যাবে। কপাল দেখেন।’

মসজিদের পর আমরা একটা চার্চও আবিষ্কার করলাম। তার ওপাশে একটা ভাসমান ভাতের হোটেল। ইসমাইলকে বললাম, ‘আমি এখন বড় অফিসার। বড় মাছ দিয়ে ভাত খাব।’

ইসমাইল পাহাড়ী হোটেল মালিককে জিজ্ঞেস করলো, ‘বড় মাছ আছে?’

হোটেল মালিক জানালো, ‘বরো মিরকেল মাছ আছে।’

এরপর আমরা ভাতের অপেক্ষায় লেকের উপর ঝুলন্ত বারান্দায় বসে থাকলাম। দূরে নীল পাহাড়। কাছে সবুজ পাহাড়। কচুরিপানা ভেদ করে একটা ট্রলার এগিয়ে আসছে। সেটা নিকট হতে বুঝতে পারলাম যে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। গেরুয়াধারী আর মাথায় চুল নেই। সে মুরগির মাংস আর বড় মাছ দিয়ে ভাত অর্ডার করলো। আমরা শুধু মাছের সাহায্য নিলাম। সঙ্গে কচুর লতি আর আলুভর্তা।

তখন কারও কণ্ঠে গান বেজে উঠলো, হারমোনিয়ামের তালে তালে এক পুরুষ কণ্ঠ বাজছে, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান।’ উঠে গিয়ে দেখলাম, পাহাড়ী হোটেল মালিকের বালক পুত্রকে গান শেখাচ্ছে এক বাঙালি যুবক। বালকের মা কলা আর এক গ্লাস দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। যুবক আমাদের দেখে কিছুটা বিব্রত হল। বৌদ্ধ ভিক্ষুটি আবার ট্রলারে উঠে নীল পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, ইঞ্জিনের ভটভটাং শব্দে চারদিকে হঠাৎ যেন নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।

খাওয়া শেষে বারান্দায় বসেই ইসমাইল জানতে চাইলো, ‘ভাই বিল কত হল?’

জবাব এলো, ‘দুইশত পাচপান্ন টাকা।’

****

ফেরার পথে রেগুলার ট্রলারের কোনটাই পেলাম না আমরা। ঘাটে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ বললেন, ‘অয়েট করেন। সামনে দিয়া মেলা টলার যায়। ডাকলে উঠাইয়ে নেবে।’ বেশ কিছুক্ষণ ঘাটের জলে পা ভেজালাম। ইসমাইল একটা সিগারেট ধরালো। রোদ কমে এসেছে।

‘কেমন বুঝলা বন্ধু?’

‘ভালোই তো। এই ছোট্ট দ্বীপের মত গ্রামে মানুষ কেমন জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।’

‘এই রকম এক পাহাড়ঘেরা যায়গায় জীবন আসলেই কাটাইয়া দিবার ইচ্ছা করে। মানে ভাবো ম্যান, ঘুম থেইকা উঠতেছো আর চোখ মেলে যদ্দূর তাকাইবা, শুধু পাহাড়। সেইসবের আবার রঙ বদলায় প্রতি বেলা।’ 

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একটা মালবাহি ট্রলারে উঠবার সুযোগ পেলাম। ওরা রিজার্ভ বাজারে যাবে। মাঝিমল্লা সবই বাঙালি। দূর থেকে যেই পাহাড় আর মানুষের কল্পনা করতাম, তার কতটা মিলছে এই কয়েক দিনে? চারদিকে শুধু সেটেলার। সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। পাহাড়ী মানুষ আর সেটেলার, কেউই কাউকে তেমন বোঝে বলে মনে হলনা। কেউ কাউকে তেমন পছন্দও করেনা। কিন্তু সংগ্রামে ওরা কেউ কারও চেয়ে কম না। কাজ করে খাচ্ছে। বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। দূর দূর থেকে ছোট নৌকায় চড়ে ছেলেমেয়েরা স্কুলের জন্যও চলে আসে রাঙামাটি শহরে।

দুই ধারে উঁচু পাহাড়। বছরের পর বছর বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে পেয়ে তাদের গায়ে বিচিত্র নকশা তৈরি হয়েছে। মাটির শরীর কেমন হয়ে উঠেছে পাথুরে। মৃদু শব্দ ট্রলারের ইঞ্চিনে। তার চেয়েও চড়া হয়ে কানে আসছে জল কাটার মিষ্টি শব্দ। ইসমাইল মাঝিদের সিগারেট খাওয়ায়। আমাকে আরেকবার সাধে। আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা পাহাড়ের মাথায় সোনালী বৌদ্ধমূর্তি। সূর্যের শেষ আলো যার উপরে পড়েছে আর মহান জাতকের শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে।

অতঃপর চারদিক অকস্মাৎ অন্ধকার করে এলো। এত মেঘ কোত্থেকে হাজির হয়েছে আকাশ জুড়ে কে জানে। কালচে হয়ে উঠলো লেকের নীল জল।

****

সন্ধ্যায় হোটেলের বেজমেন্ট কামরাটি ছেড়ে আমি একা একা বের হয়ে পড়েছিলাম  রিজার্ভ বাজারের পথে। পাহাড় থেকে নামতে নামতে যে ঢালু সড়ক মিশেছে নীলচে পানির এক হ্রদে, হ্রদের নিচে লুপ্ত গ্রাম আর অজস্র মানুষের বোবা চিৎকার, কান পাতলেই শোনা যায়।

ছোট্ট শহরটা ভরে গেছে বাঙালি লোকজনে। যাও বা কিছু স্থানীয় চাপা নাক ছোট চোখের, কেউ বড় কাছে আসতে চায়না, দুরত্ব রেখে রেখে চলে, চোখে এক ধরনের অস্বস্তি তাদের। নাম ভুলে যাওয়া পাহাড়ী তরুণটি কথা দিয়েছিল সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে যাবে বন মোরগের শিক খাওয়াতে, কাছেই আরেকটি বাজারে অন্ধকার নামলেই গনগনে আগুণের পাশে ওসব পাওয়া যায়, সঙ্গে স্টিলের গ্লাসভরা চুয়ানি। কিছুই হলনা। ইসমাইল সকালে গিলেছিল এলাচ। হ্যাংওভার কাটিয়ে সে ঘুমে উপুড়। পাহাড়ী তরুণটিকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে হঠাৎ করেই।

অথচ সকালটা সুন্দর শুরু হয়েছিল। বাস থেকে নেমে আগে থেকে ঠিক করা হোটেলে উঠেছিলাম। সাময়িক ভাবে আমাদের যে রুমে ওরা থাকতে দিল সেটির টয়লেটে জল উপচে পড়ছে। সঙ্গে বিগত অতিথিদের চিহ্ন হিসেবে এক খন্ড পুরিষ। প্রায় আতংকিত হয়ে আমরা পরপর অনেকগুলো হোটেলে ঢুঁ মারলাম। অতঃপর যেখানে যায়গা হল তা পুরনো কিন্তু চমৎকার। আমরা পেলাম বেজমেন্টের এক ডাবল বেড কামরা। ইসমাইল বললো, ‘চল একটু ঢুঁ মারি এলাকায়। অখনে ঘুমাইলে সারাদিন নষ্ট হইব।’

দিন নষ্ট হতে দিলে চলবেনা। তাই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ী তরুণটির বড় সংসার। বউ। বাচ্চা। অনেকগুলো শালী। আর ঘর ভরে আছে ছোট বড় অজস্র বোতলে। নিজস্ব কায়দায় এরা চুয়ানী বানায় এলাচ বানায়। স্টিলের গ্লাসে করে এলাচ এলো। সঙ্গে শুকনো মাছ আর লতাপাতা দিয়ে বানানো ভীষণ ঝাল এক ভর্তা।

এর কিছুক্ষণ পর ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে আমরা একটা নৌকা ভাড়া করেছিলাম। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, বহুক্ষণ ধরে আমাদের পাশে পাশে থাকা পাহাড়ী তরুণটি হঠাৎ অদৃশ্য হয়েছে। সন্ধ্যায় যে ওকে আর পাওয়া যাবেনা, এই যাত্রায় যে ওর সঙ্গে আর দেখাই হবেনা, কে বা জানত। 

নৌকায় দুলে দুলে লেকের মাঝামাঝি নিয়ে গেল আমাদের মাঝি। ইসমাইল বললো, ‘ঐ লোকটারে নিয়া ভাবতাছ? ওরে নিয়া ভাবার কিছু নাই।’  

কিছু আগেই তো ছিল সঙ্গে, গেল কোথায়?

‘মাইন্ড করছে। ওর এলাকা। আমরা নিজেরা নিজেরা নৌকা ঠিক করলাম আগ বাড়ায়া।’

কউ কী?

‘হ। হেভি মাইন্ড খায় অয়। আগের বারে আইসাও দেখছি। পোলা ভাল। অর এক শালারে রাজধানীতে কাজে লাগাইতে চায়।’

তুমি মিয়া খেয়াল করবানা?

‘কী আর খেয়াল করুম? অয় থাকলে অবশ্য ভাল হইত। নৌকায় চইড়া ছোট্ট এখ্যান পাহাড়ে যাইতাম। সেই দ্বীপে ওর শশুরবাড়ী।’

এটুকু কথাবার্তার পর হড়হড় করে সে বমি করলো লেকের জলে। অতঃপর মাঝিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘চাচামিয়া, এত বড় লেক, রাইতের বেলা কিছু দেখেন নাই কোনদিন?’

‘কী দেখুম?’

‘মানে ঐ যে, থাকেনা…’

‘না গো বাবারা। বিশ বশশর হইল এইখানে নৌকা বাই। কিছুই তো দ্যাখলাম না।’

এরকম ছোট ছোট ঘটনায় দিন ভাল কাটলেও সন্ধ্যাবেলাটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠলো আমার। ইসমাইল নিরুপদ্রব ঘুমে। শীতল কামরায় লেপের নিচে বসে ব্যাগ থেকে আমি বের করলাম বোর্হেসের সেভেন নাইটস। এমন বাজে অনুবাদ, বেশিক্ষণ পড়া গেলনা।

কী করি আর? পোড়া কাঠের গন্ধমাখা এক লাল আলো জ্বলছে ধরণের ক্যান্টিনে ঢুকে প্লেট ভরা হলুদ বুরিন্দা আর উদর ফুলে ওঠা পুরি দিয়ে নাস্তা সারলাম। কিছুক্ষণ পরেই গ্লাসে করে দুধ চা এলো। এরপর বের হয়ে শুটকি বাজারের দিকে চলে গেলাম আর এই পরিণতি না জেনেই যে দিন দুইয়ের মাথায় নগরে ফিরব প্রচণ্ড শরীর খারাপ নিয়ে, এই কয়েক দিনের কনসিসটেন্ট সান্ধ্যনাস্তা হবে অসুস্থতার মূল কারণ। আর ঐ যে পাহাড়ি তরুণ, ওর খোঁজ নেব না ইচ্ছে করেই। কেনো না আমাদের মনে হবে অযথা ঝামেলায় জড়ানো অনুচিত। ওর খোঁজ নিলে পুলিশ আমাদের কি সন্দেহ করবে না? নিজেরা নিজেদের সান্ত্বনা দেব এই বলে যে, ‘থাক, ও এমন প্রায়ই ধরা খায়। জামিন পেতে ওর সময় লাগবে না।’

****

প্রচন্ড বৃষ্টি নামল। ট্রলার ছাউনির নিচে চালের বস্তা। দুদিকের মুখ তেরপোল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তীব্র বাতাসে চড়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ছুরির ফলার মত গেঁথে যেতে চাইছে সব কিছুতে। এই ঘোলাটে হয়ে উঠছে চারধার। আবার বুঝি সব দেখা যাচ্ছে জলধারা ভেদ করেও।

‘এমন একটা বিকেল পাইবা কখনও ভাবছ জীবনে?’

কেই বা ভাবে? ইসমাইলকে আমি বললাম, ‘দূরের ঐ পাহাড়সারির দিকে তাকাও। কী অপূর্ব দৃশ্য।’

ঐদিকে কী বৃষ্টি নেই? লাল হয়ে আছে। ডুবছে সূর্য। কালচে পাহাড়গুলোর শরীর নয়।  যেন ওসব অতিকায় সব ডায়নোসরের পিঠ। আর তখন আমরা কিছু আগে আগুনে জ্বলতে থাকা বৌদ্ধমূর্তিকে পাশ কাটাচ্ছি। প্রবল বৃষ্টিতে মনে হল বুদ্ধ এখন কাঁদছেন।


[রচনাকাল – ২০১৮]

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন