যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী

bout wajid ali shah

আওধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্‌কে নিয়ে কোলকাতার মুসলিম জনপদে নানান গল্প প্রচলিত ছিল এক সময়। নবাব দারুণ বিলাসী ছিলেন। নাচ গান শিল্প সাহিত্য ভালোবাসতেন। তবে সবচেয়ে মজাদার গল্প ছিল সম্ভবত নবাবের ভোজনরসিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে।

এই গল্পগুলো আমি শুনতাম আমার নানা ভাইয়ের মুখ থেকে। সেসবের একটা এমন –

প্রতি রাতে নবাব ছাগদুগ্ধে তৈরী খাঁটি ঘিয়ে ভাজা লুচি ও গরুর মাংস ভুনা খেতেন। প্রতিটি লুচি ভাজা হত আলাদা আলাদা কড়াইয়ে। এক ঘিয়ে দুটি লুচি ভাজা হলো কিনা, নবাব সেটি মুখে দিলেই ধরে ফেলতেন, এবং বাবুর্চির জীবন সংশয় হতো। এমনই ছিল তার রসনার ধার।

তবে একবার ঘটে গেলো বড় বিস্ময়। লুচি মুখে দিয়ে নবাব থু করে ফেলে দিলেন। এবং কড়া গলায় হাঁক পাড়লেন, ‘বাবুর্চিকে ডাকো। তুরান্দ।’

বাবুর্চি নবাবের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। নবাব বললেন, ‘আজ যে ঘিয়ে লুচি ভেজেছিস, এ কেমন ঘি? একি ছাগদুগ্ধের না কুক্কুরদুগ্ধের?’

বাবুর্চি বলল, ‘গোস্তাকি মাফ হয় মালিক। আপনার হাতে আমার প্রাণ। আপনার লুচির জন্য ঘি আমি নিজে খরিদ করি। এবং যখন তা প্রস্তুত করা হয়, তখন আমার সামনেই তা প্রস্তুত করা হয়।’

‘তাহলে ডাক সে ঘি’অলা ময়রাকে।’

ময়রা কাঁপতে কাঁপতে হাজির হয়। কড়জোরে বলে, ‘হুজুর এ খাঁটি ছাগদুগ্ধ। কুকুরের দুধ নয়। আমার নিজের ভাইয়ের পালা ছাগলের দুধ।’

‘নবাব বলেন, এ হতেই পারে না। আমার জিব আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না। ডাক তোর ভাইকে।’

ময়রার ভাই নবাবের অভিযোগ শুনে হু হু করে কেঁদে ওঠে। বারবার বলতে থাকে এমন মহান নবাবের পায়ে সে চুমু খেতে চায়। কিছুটা নরম হয় ওয়াজেদ আলি শাহ্‌র মন। তিনি ময়রার ভাইকে আদেশ করেন, ‘কী ঘটনা, আমাকে খুলে বল।’

লোকটি জানায়, ‘আমার যে চারটি ছাগলের দুধ থেকে ঘি তৈরী হয়, জন্মের সময়েই এদের মা মারা যায়। আমার বাসার পাহারাদার কুকুরটি তখন দুগ্ধবতি ছিল হুজুর। সেই কুকুরের দুধ খেয়ে এই ছাগলগুলি বড় হয়েছে।’

ওয়াজেদ আলি শাহ্‌র রাজসিক রসনার তীক্ষ্ণ ক্ষমতায় সকলে অভিভূত হয়ে যায়। এই না হলে নবাব। পুরো দরবারে ধন্য ধন্য রব উঠতে থাকে।

কবি ও গায়ক ছিলেন নবাব। কথিত আছে, ঐ সময়ে সারা ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা শিল্পের সমঝদারও ছিলেন। বৃটিশরাজের হাতে সিংহাসন হারানোর পরেও তার প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবহার ও ব্যবস্থা দেখেও সেটা প্রমাণিত হয়। অবশ্য দিল্লির পতনের আগে থেকেই আওধ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুগত ছিল।

কত্থক নাচের এক প্রধান ঘরানা হলো লখনৌ ঘরানা। এই নাচকে রাজদরবারের বিনোদন হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনি। মন্দির ছেড়ে কত্থক সর্বভারতীয় নৃত্যকলায় এক জনপ্রিয় নাম হয়ে ওঠার পেছনে নবাবের ভূমিকা অনেকেই স্বীকার করেন। এ ছাড়া ঠুমরিগীতির প্রণেতা হিসেবেও তার খ্যাতি আছে।

রাজ্যহারা হলেও নির্বাসিত নবাব তার বিশাল বাহিনী নিয়ে কোলকাতায় প্রবেশ করেন ১৮৫৬ সালে। এই বাহিনীতে ছিলেন গায়ক, সঙ্গীতজ্ঞ, নর্তকী, চিত্রকর, সুরসিক, পন্ডিত এবং নানা পদের লোকজন যারা নবাবকে আনন্দে রাখতেন। তার নিবাস ছিল মেটিয়াবুরুজের এক বাগানঘেরা সুরম্য প্রাসাদে, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হুগলি নদী। স্থানীওদের কাছে আওধের নবাবই হয়ে ওঠেন মেটিয়াবুরুজের নবাব।

নিজের প্রিয় লক্ষ্ণৌ শহর ছেড়ে আসার সময় দু:খী নবাব লিখেছিলেন এই বিখ্যাত ঠুমরি – ‘যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী

কহে হাল আদম কি পার কেয়া গুজরি’

পাদটিকা (ফলের চেয়ে দানা বড়):

শতরঞ্জ কে খিলাড়ি নামে ওয়াজেদ আলি শাহ্‌কে নিয়ে সিনেমা বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। মুন্সি প্রেম চাঁদের গল্পটা সত্যজিতের পছন্দ হওয়ার কারণ বোঝা যায়। এই সিনেমার বক্তব্য ছিল জনতার সাথে শাসকদের দূরত্ব ও শাসকদের আত্মকেন্দ্রিকতাই ভারতবর্ষের পরাধীনতার জন্য দায়ি। অর্থাৎ, সাম্রাজ্যবাদি বৃটিশদের কুটচালের চেয়ে ভারতবর্ষের শাসকদের দোষই যেন বা বেশি ছিল। যেই ন্যারেটিভ আমরা দেখি আরও পূর্বের ইতিহাসে, লক্ষণ সেনের পরাজয়ের কাহিনীতেও (ভারতে মুসলিম শাসকদের এ বিজয়গাথার ন্যারেটিভ আবার এন্টিকাটার হিসেবে কাজ করে মুসলিম শাসকদের হাত থেকে ভারতবর্ষের শাসন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে)। এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি আজ আমাদের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হলেও শতরঞ্জ কে খিলাড়ির শিল্প ও বিনোদনমূল্য অতুল। আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।

স্মৃতি থেকে মনে পড়ছে (তাই ভুল হতে পারে) সুনীলের ‘সেই সময়’ উপন্যাসে ওয়াজেদ আলি শাহ্‌র একটা ঘটনার উল্লেখ আছে। মেটিয়াবুরুজে ছদ্মবেশে নবাবের প্রাসাদে এসেছে এক বিপ্লবী। নবাবকে বলছেন বিপ্লবের কথা। তা শুনে নবাব কেঁদে ফেলছেন আবেগে, এবং বিপ্লবীকে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন এই বলে যে, তার বন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ছিঃছিঃ।

অর্থাৎ, আমোদপ্রিয় নবাবের নানান ত্রুটি ছিল। কিন্তু স্থানীয় শাসকদের দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিনতার সুযোগ নিয়েই যে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করে নিতে পেরেছিল – এই রাজনৈতিক ধারণার সুতো সাহেবদের হাতেই তৈরি।

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন