খোঁয়ারির মত

reza at old Dhaka

ইলিয়াসের খোঁয়ারি গল্পের বাড়িটার মত এক ভঙ্গুর পুরাতন বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম।

দোতলা বাড়ি, নিচতলায় সাইকেলের দোকান, উপরের তলার দেয়ালে ফুলের নকশায় কালচে শ্যাওলা। টানাবারান্দাটি এক সময় খোলা ছিল বোঝা চলে, ঘিঞ্জি লোহার শিক টানা হয়েছে পরে।

ভিতরের দরজা জানালার ওপাশে অন্ধকার, কেউ থাকে অনুমান হয়, কীভাবে থাকে তা বোঝা কঠিন। ছাদের উপরে আরও একটা দেয়াল কেউ তুলতে চেয়েছিল, লাল ইটগুলো উঁচু থেকে দারুণ ব্যাস্ত পুরনো শহরের নতুন মানুষগুলোকে ভেংচি কাটছে।

মানুষের ভিড়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা গেলনা। কাপ্তান বাজারের মোড় হয়ে নবাবপুর রোড ধরে হাঁটছিলাম। এরপর কখন বংশালে ঢুকে পড়েছি, অনবরত হাঁটছি, কতক্ষণ সেটা জানতে ইচ্ছে করছেনা।

কোন কোন ছুটির দিনে নিজেকে এই বিলাসিতা দেওয়াই যায়, এমন একটা ভঙ্গিতে চকবাজার এলাকায় পৌঁছলাম। উর্দুরোডের কাছাকাছি এসে মনে পড়লো নানাভাইকে। পুরনো শহরে জীবনে প্রথম এসেছিলাম ঐ মানুষটির সঙ্গে। বছর কুড়ি আগের কথা হবে।

যৌবনে নানাভাই ঐসব দিক দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। চিরকাল লোকটা গল্পকার হতে চাইতেন, আর নিয়তি তাকে বানিয়েছিল পোশাকের কারবারি, উর্দু রোড এলাকায় জমিয়ে বসেছিলেন বহু বহু গল্পের জন্ম দিয়ে।

কোলকাতা, বৃটিশ শাসন, দেশভাগ, দাঙ্গা, নওগার জীবন, আর মিরপুর এলাকায় বসতি গড়ে নেবার বিচিত্র ইতিহাস তার ঝোলায় ছিল। এসমস্ত ভাবতে ভাবতে উর্দুরোডের এক প্রায়ান্ধ গলিতে আরও একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হল।

রঙচটা মোটা দেওয়ালের বাসা। অর্ধেকটায় বনজঙ্গল, দেয়ালে লতিয়ে-পেঁচিয়ে আছে পরজীবী বৃক্ষ। বাকি অর্ধেকে ভাঙা কাঠের সদর দুয়ারের ওপাশে মানুষের সংসার, কারা ওরা জানবার অক্ষমতা নিয়ে চারপাশের আরও অনেক গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো বহুতল ভবনগুলোর দিকে তাকালাম কয়েকবার।

অতীত-বর্তমানের মাঝামাঝি ঝুলতে থাকা প্রাচীন নিবাসটির সামনে বসে উদোম গায়ের এক লোক গভীর মনযোগে দাঁত মাঝছে কয়লায়, তার দৃষ্টি মাটির দিকে।

ওভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়না। হাঁটতে হাঁটতে নানাভাইকে মনে পড়ে আবার। বুঝলাম আমার আশেপাশেই লোকটা কোথাও আছেন। যার কাঁধে নিজের লেখক হতে না পারবার আক্ষেপ আর সীমাহীন গল্পের ঝোলাটা তুলে দিয়েছিলেন বহু যুগ আগে, তাকে নিশ্চয় তিনি চোখে চোখেই রাখেন।

সন্ধ্যার আগে আগে মিরপুরে পৌছলাম এক ধরণের ‘কেমন করতে থাকা’ মন নিয়ে। ক্যালেন্ডারের পাতায় উনিশ জানুয়ারি। আমার তো খেয়ালই ছিলনা দিনটা। ছিলনা বলেই মহানগরের ঐ প্রায় পৌরাণিক প্রান্তে আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, স্মৃতি জাগিয়ে তোলার ভার বড় ভার।

পৃথিবী থেকে মোহাম্মদ মিকাইল হারিয়ে গেছেন, কিন্তু তার ছোটখাটো দেহের দীর্ঘ ছায়া আমার জীবনে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরো হচ্ছে।


[রচনাকাল – ১৯শে জানুয়ারি ২০২০]

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন