হাসপাতালে

হাসপাতালে

আমার পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে।

এইখানে, মাঝারি আকৃতির এ রুমটায় ঘুমাই, ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি অথচ জাগবার পর মনে পড়েনা। স্বপ্ন দেখা হয়েছে, অস্বস্তিকর, ভয়ানক কিছু স্বপ্ন—এটুকু খেয়াল হয় শুধু। দিনমান এদের কথা ভেবে কিংবা স্মরণের বৃথা চেষ্টায় মগজে বেদনা জন্মায়, সে বেদনার তোড়ে চারপাশে আর তাকানো হয়না গভীর মনযোগে। লোকে গালি দিলে মাথায় ঢোকেনা কিংবা কোন কাজে কাঁধ চাপড়ে কেউ প্রশংসা করলেও বুঝে উঠতে পারিনা।

আমার ভুবন ছোট হতে শুরু করে একটা ভোর থেকে।

রাত্রিভর স্বপ্ন দেখি রোজকার মতই এবং মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে পানি খাই, পেশাব করি তে’তলার ঝুলবারান্দার এক কোণে, পানি যাওয়ার ছোট্ট নালাটা দিয়ে তলপেটের বর্জ্য তরল ছড়ছড়ায় নিচের আরেক নালাতে—যেখানে তাবৎ শহরের বর্জ্য গিয়ে মেশে, কুলকুলিয়ে কোথায় চলে যায়। এরপর দুর্বল পায়ে হয়ত আবার বিছানায় মেলে দেই শরীর, হয়ত কাঁপি, বিড়বিড় করি। খুব বেলায় ঘুম ছুটলে অস্থির লাগে, চলচ্চিত্র হয়ে মগজের পর্দায় ভাসতে থাকে রাতভর কিসব দেখেছি, অন্যান্য দিনের মত ভুলে যাওয়ার কথা থাকলেও ভুলিনা।

বাথরুমে পানির কল ছেড়ে দাঁত ব্রাশ করি, গায়ে পানি ঢালি, স্বপ্নটা মনে পড়ে: একটা খুন করেছি। আসলে একটা না, জোড়া খুন। আসলে তাওনা, একটা মেশিনগান হাতে ঢুকে পড়েছি কোন জনসভায় আর গুলিভর্তি মারণাস্ত্রের ট্রিগার চেপে আছি; আমায় পাশ কাটানো মানুষ মরছে, পলাতক মানুষ মরছে, কিছু সামনে এগিয়ে আসা লোকজন তারাও মরছে। সন্ধ্যা হবে হবে এমন একটা সময়, চারদিকে লাল-শাদা আলো, রিকশা আর বাসের শব্দ’র মাঝেই এত এত লোকজন, কেউ কারও দিকে চাইছেনা—তারা হয় গুলি খাচ্ছে, নইলে পালাচ্ছে। তখন কে এক মধ্যবয়সি মহিলা, মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা—সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে এক পাটি স্যান্ডেল। মেশিনগানের ট্রিগার থেকে আঙ্গুল সরিয়ে রক্তাক্ত মহিলার স্যান্ডেল আমি নেই, নাক লাগিয়ে শুঁকি। মহিলাটি বলে, “ভাল মত শুঁকুন, শুঁকে শুঁকে আসল যায়গায় গিয়ে মেশিনগানের ট্রিগার চেপে ধরবেন।” আমি মেশিনগান ছুঁড়ে ফেলে জুতোটা শুঁকতে শুঁকতে দৌড় দেই, পিছনে শুনতে পাই মারণাস্ত্র আবার চালু হয়েছে, বাড়ছে মানুষের চিৎকার—অন্য কেউ যেনবা মেশিনগানটি হাতে তুলে নিল আবার।

ঠিক এমন একটি স্বপ্ন কেন দেখি? আমার মাঝে অবচেতনে একজন খুনীর বসবাস আছে? চিন্তাগুলো চেপে বসে মস্তিষ্কে, অস্বস্তি, সুতীব্র এক মন্দলাগা নিয়ে খাটের পর নিজের দেহটা ছুঁড়ে দেই—যেন চাইনা তবু গড়িয়ে পড়ি। এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েও পুনরায় ঘুম ভর করতে চায় দু’চোখে, মাথায় বেদনা হয়—ধপধপাচ্ছে যে কপালের দুদিকে শিরা, টের পাই। অস্বস্তিটা ছেড়ে যায়না কিছুতে, এমনি কী খারাপ আমি যে আমার ভিতরে একজন খুনীর বসবাস আছে? সেলফোনটা হাতে নিয়ে নয়নতারার নম্বরে ডায়াল দেই, ওপাশে রিং হয়।

‘সার, স্লামালিকুম। ভাল আছেন?’

মেয়েটার কন্ঠস্বরে খানিক চিন্তা হয়ত খেলে যায়, অন্যসময় হলে এই রমণীয় আবেগটা ভোগ করা চলতো অথচ মাথা থেকে অস্বস্তি যায়না এখন। কিরূপ একটা খচখচানি নিয়েই বলি ভাল, ‘আছি ভাল তারা। একটা দরকারে আপনাকে ফোন দিলাম।’

‘জ্বি সার বলেন।’

‘খুব বিশ্রী একটা স্বপ্ন দেখেছি, এরপর থেকে শরীরটা অসুস্থ লাগছে। আপনি কি আজ একটু ম্যানেজ করবেন সলিমুল্লা ভাইকে?

সেকি, খুব খারাপ লাগছে নাকি? ডাক্তার দেখাবেন?’

‘না তেমন কিছুনা। আপনি শুধু একটু ম্যানেজ করে নেবেন।’

‘জ্বি সার, আমি সলিমুল্লা সারকে বলে দেব যে আপনি অসুস্থ। ঠিক আছেনা?’

‘স্বপ্নটপ্ন দেখেছি বলার দরকার নেই, আপনি বুঝবেন তাই আপনাকে বলা।’

এইত, এই পর্যন্ত ছিল—ঐ যে আমার জুনিয়র নয়নতারাকে বলে ছুটি নেয়া পর্যন্ত, ওদিন আর অফিসে যেতে পারলাম না, মাথায় দুঃখ নিয়ে ধপধপানো শিরা নিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে রইলাম। চারকোণা ঘরটিকে মনে হল মহাশূন্য, কোন শব্দ নেই অথচ মনে হওয়াটা তো ভুল। খানিক দূরেই মূল সড়ক থেকে বাস-ট্রাকের হর্ণ আসছে, মানুষের হল্লা, মাঘের বেদনাদায়ক শীতের হাওয়া থেকে থেকে বাড়ি খাচ্ছে জানালার কাঁচে। বিছানা থেকে ঠিক একটা লুলা ফকিরের মত গড়িয়ে গড়িয়ে জানালার কাছে গেলাম, একেকদিন এমন করতে ভাল লাগে—আজ এটা করলাম মনযোগ অন্যদিকে সরাবার অভিলাষে, এতে যদি অস্বস্তি কাটে। দাঁত দিয়ে পর্দার কোণা ধরে টেনে আমি জানালার ওপাশের দুনিয়া দেখতে চাইলাম। পর্দা সরলো। তবে স্টান্ড ভেঙে হালকা ও চকচকে সুতোর পলিস্টার বস্ত্রখন্ডগুলো ঢেকে দিল দৃষ্টি, এমন রাগ হল!

ওদিন রাগের চোটেই আমি কিছু খেলাম না সারাদিন, গাঁট হয়ে নিজের বিছানায় পড়ে রইলাম যেন অথর্ব বৃদ্ধ এক, সিলিং দেখলাম, নিজেকে নিয়ে ভাবতে দুঃখ হল—তাও দেখলাম, নিজের দুঃখ।

এই যে আমি বৈকালিক এক চাকুরি করি, সপ্তায় পাঁচদিন যাই সেখানে, বাসায় ফিরি, খাই-হাগি-মুতি, প্রায় নিজের প্রতি গভীর নিষ্ঠা নিয়ে ঝাঁকাঝাঁকি করি পুরুষাঙ্গ ধরে—গেল বছরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া বউয়ের কথা কল্পনা করি, দিলরুবা, খুব হ্যাংলা পাতলা সেই নারীটি তিন বছরের সংসারে যেমন আমার সঙ্গে শুয়েছে, আমার উপর ঘোড়া চালিয়েছে অনেক রাত্রে কিংবা হয়েছে কুকুর, আমি তাকে করেছি, সে আমাকে, এখন আমার এহেন একলা জীবনেও এইসব শীতের রাতে বাথরুমের ঠান্ডা মেঝেতে হাঁটু রেখেও কুকুর আসনে তাকে কল্পনা করে নেই—খুব জমে, উত্তেজনার তুঙ্গে পৌঁছলে শূন্য চারদিক কাঁপিয়ে হেসে উঠি।

অট্টহাসিটা নিজের হৃদয়ের কাছেই অমন বেসুরো লাগে, যেমন ছেঁড়া তারের ভায়োলিনে ছড়া ঘষলে খসখস শব্দ ওঠে। আমার দুনিয়া ছোট হয়ে যায়, এমন কি করি যে একটা বিশাল পৃথিবীর বাসিন্দা হতে পারলাম না এই পাঁচত্রিশে এসেও? পাঁচত্রিশে পারিনি পাঁচপঞ্চাশেও কি পারবো? এইটুকুন পৃথিবী আমার, ভেবে দুঃখ লাগে।

আম্মা-আব্বার থেকে আলাদা থাকছি নাকি তারা আমার সঙ্গে থাকতে ভাল পাননা এই ভেবে তাদের ছেড়ে শহরের আরেক প্রান্তে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলছে বসবাস—তা শুধুই কি অফিস থেকে কাছে, যাতায়াতের ঝক্কি সামলাতেই? আর কোনদিন অতশত না ভেবেই দারুণ জীবন কাটিয়ে যাচ্ছিলাম এমনকি দিলরুবার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পরেও গায়ে বেদনার হাওয়া লাগেনি, সত্যি বলতে বিছানায় দিলরুবা খুব একটা ভাল ছিলনা—আমি আরাম পেতাম না, ওর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর প্রথমেই যা মনে হয়েছিল, এইবার হবে—প্রচুর মেয়েমানুষের সাথে মিশবো একেবারে নিশ্চিন্তে। কেউ না কেউ তো আরাম দেবে। কিন্তু ওইদিনটায়, যখন বুঝতে পেলাম আমার দুনিয়া খুবই ছোট, মনে পড়েছিল বাপের কথা—আমার বাপ কি আরাম পেয়েছে মায়ের থেকে? পেয়েছে নিশ্চয়, কী সুন্দর ছয়জন পুত্রকন্যার জন্ম দিয়েছে আব্বা-আম্মা একে একে। আমি ক’নম্বর? হাজার চেষ্টা করেও ওদিন মনে করতে পারলাম না, চারটা হিউম্যান হলারের মালিক আমার বাপের আর তার বউ আরকি আম্মার ক’নম্বর সন্তান স্মরণ হলোনা মোটেই।

যত দিন গেল, অস্বস্তি আরও বাড়ল।

অফিসে যাওয়া বন্ধ করলাম না, হৃদয় সচেতন হয়ে জানালো সে চিন্তা করতে পারছে কারণ এটুকু অবসর পেট তাকে দিচ্ছে—থাকা খাওয়ার সংকট আমার নেই, দিলরুবাকে ভেবে ভেবে বাথরুমের মেঝেকেও আঠালো করি, ভাল লাগে খুব—শুধু সকাল শুরু হয় এই দুশ্চিন্তায়: পৃথিবী খুবই ছোট, আমার সন্তান নেই, শিক্ষক নই যে ছাত্র থাকবে—অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে দেব; মরে গেলে আমার কথা কেউ স্মরণ করবেনা, আস্ত একটা মানুষ আমি, এই যে নিত্য হেঁটে হেঁটে যাই কতনা যায়গায়, কতনা কথা বলি অফিসের নির্বাহী কত্তা সলিমুল্লা ভাইয়ের সাথে—এইসব শুধু হবে একটা আঁতকা পাওয়া জীবন ফুস করে পেরিয়ে যাবার নিদারুণ কৌশল, কে যেন এমন বলেছিল, ‘কৌশল ভালনা, কৌশল বের করবার পূর্বে তার উদ্দেশে যে চিন্তা—ওটুকু ভাল।’ মন্দ লাগা ছাড়া আর কী ভর করবে মনের উপরে তবে?

একদিন নয়নতারাকে ডেকে বললাম, ‘আজ অফিস শেষে আমার সাথে কি যাবেন আপনি?’

‘কোথায় যাবেন সার, কেনাকাটা করবেন নাকি?’

‘হ্যাঁ। করব। এত জিজ্ঞাসেন কেন? যাবেন কিনা বলেন।’

‘বাসায় তো সার দেরি করে ফিরবার উপায় নাই। বাবুটা খুব কান্দে আজকাল।’

‘আপনার বাবুর বয়স কত?’

‘আড়াই বছর।’

‘এত বড় বাচ্চা কান্দে? মাইর দেন না কেন?’

‘ছিছি সার কি বলেন, আমার দুধের বাচ্চা, মারবো?’

দুধের কথা বলায় আমার ভিতরে রক্ত ছলকে উঠলো, কেন উঠলো? নয়নতারা, সাতাশ-আটাশ বছরের নয়নতারার খুব খারাপ লেগেছে আমার কথায় বুঝতে পারলাম, আমি তার দিকে তাকালাম—মূলত তার বুকের দিকেই, হালকা সুতোর কাজকরা ফতুয়ার উপর দিয়ে বোঝা যাচ্ছিল দুটি বিশাল স্তনের অস্তিত্ব। বেশ লাগছিল। নিজেকে ধিক্কার দিলাম, এতদিনে কেন মনে হলনা নয়নতারার কথা? কতইনা শখ ভেবেছিলাম, দিলরুবার সাথে ছাড়াছাড়ির পর কতরকম নারীর বুকে হাত রাখবো, কত জনার তলপেটে বুলাবো হাত, কত রকম ঠোঁটের স্বাদ, ইত্যাদি।

‘সার আমি যেতে পারবনা, সরি।’

‘তাহলে আমাকে একদিন কেন দাওয়াত করেন না? আপনার বাচ্চাটাকে দেখলাম।’

‘আমার জামাই তো এইসব পছন্দ করেনা, উনি অফিসের ঝামেলা বাসায় আসুক চাননা।’

পাশের ডেস্কে বসে নয়নতারা কম্পিউটারের পর্দায় মনযোগ দিল। সরাসরি খোঁচাটা এত লাগলো গায়ে, আমার মত একটা লোককে এভাবে বলতে পারলো? এমন কি মন্দলোক আমি? নাহয় বলেছি বাচ্চা কাঁদলে মেরে থামাতে, নাহয় তাকিয়েছি বুকের দিকে। এসব এত কি খারাপ? ওর স্বামী যেন তাকায়না ওর বুকের দিকে?

খুব রাগ হল আমার। মনে হল নয়নতারাকে ফায়ার্ড করে দেই অফিস থেকে, কী এমন বুক রে, তার কত দেমাগ। আমার মত দার্শনিক লোক নয়নতারা কি জীবনে আর একটা পেয়েছে?

আমি দার্শনিক কিনা এটা ভেবে ভেবে আবার নিজের মাঝে একটা আরামদায়ক আবেশ ম’ম করে, একটা চিন্তাভাবনার বিষয় আমার আছে, নিজস্ব বিবেচনা আছে, কিছু ঘটে গেলে আমি সেটিকে ফসকে যেতে যে দেইনা, ভাবি। খুব ভাবি এই যেমন বাসে উঠলে কন্ডাকটর একদিন ভাড়া চাইলো, আমি শুনলাম পুষ্টিহীন রুক্ষ চুলের রোগা লোকটি বলছে, ‘মামা ভাড়া দে।’ ভাড়া বের করে আমি দিলাম ঠিকই, কিন্তু বাস থেকে নেমে অফিস অব্দি ভেবে চললাম, বাস কন্ডাক্টর তুই বললো নাকি? নাহ তা কেন, তুই বলেনি আমার শুনতে ভুল। নাহয় বলতেই পারে তুই—এতে কী আসে যায়? আবার ভিতরে খচখচ করতে লাগলো, আমি একটা ভাল চাকুরিওলা লোক, বিশ্বস্কুল পাশ দেয়া লোক, সামান্য বাস কন্ডাকটর হয়ে তুই বলে দিল আসলেই? আমার কি তবে সেরকম শক্তি নেই ব্যক্তিত্বে? এইসব চিন্তায় মগ্নতা এমন বাড়লো, অফিসের স্ক্রাম মিটিঙে প্রায় জোরেই বলে উঠলাম, ‘না নাহ তুই বলেনাই, আর বললেই কি, তাই বলে তুই বলবে?’ খুব হাসাহাসি হয়েছিল ওদিন।

অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলাম মেঘ করেছে আকাশে। ক’দিন ধরেই এমন, শীতের আকাশে মেঘ থাকবে একে স্বাভাবিক মনে করতে পারছিনা। একের পর এক রিকশা যাচ্ছে, সবগুলো ফাঁকা। গলা চড়িয়ে ডাকলাম, যাবা?

‘না মামু।’

‘কেন যাবানা?’

একজনও জবাব দিলনা। অফিস থেকে বাস স্টান্ড পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে ভাবতেই বিরক্তি লাগলো। পাঁচ মিনিটের রাস্তা, ক্লান্ত মগজ নিয়ে এটুকু হাঁটতেও মনে হল যেন কয়েক মাইল পাড়ি দিতে হবে পায়ে। এলাকাটা অনেক বদলে গিয়েছে। বছর তিনেক আগে যখন ঢুকলাম এ অফিসটায়, সব ছোট ছোট দো’তলা চারতলা তেতলা ছিল ঘরবাড়ি। এখন এই হেঁটে যাই, দেখি সেসব সাধারণ বাড়িঘর হয়েছে এপার্টমেন্ট, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে এলাকাটা অফিস মহল্লা হয়েছে, আগে এমন অফিস-টফিসও ছিলনা খুব একটা। মানুষ নিজে যা, চারপাশের সবকিছুই সে নিজের মত করে ফেলে, লোকজনের মগজে এখন সংকটের ঘিঞ্জি, সুতরাং শহরটিকেও তারা ঘিঞ্জি বানিয়ে ফেললো দেখতে দেখতে। বাহ, বেশ একটা চিন্তা হল তো, শহর নিয়ে এমন করে আগে ভাবিনি—যেদিন থেকে দুনিয়া ছোট মনে হল, আমার মাঝে খুব বদল এসে গিয়েছে।

ঘিয়ে রঙের ছ’তলা বাসাটা রাত দশটার মৌনতা ধরে দাঁড়িয়ে, শীতে শহর যে ঝিমিয়েছে, বাসাটা তার প্রমাণ; প্রতিটা পর্দাটানা জানালার ওপাশে আলো জ্বলছে টের মেলে অথচ এলাকা ঝাঁ-ফকফকা, লোকজন নেই তেমন। দারোয়ান গেট খুলে দিলে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম। তেতলায় পৌছে দেখলাম দরজার সামনে ফরিদ দাঁড়িয়ে, তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট এমন মনে হওয়ায় আমার নিজেরও কেমন চিন্তিত হতে ইচ্ছে করলো।

‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? একটা ফোন দিবিনা? কী হয়েছে?’

‘বাসার কেউ কল দিলে ধরেন আপনি?’

‘বাসায় কিছু হয়েছে?’

‘আব্বার শরীর খারাপ করেছে, হার্ট ফাউন্ডেশনে আছে। যাবেন?’

‘এতবড় খারাপ অবস্থা আমাকে আগে বলবিনা?’ ছোট ভাইকে তিরস্কার করতে করতে পকেট থেকে ফোন বের করলাম আমি। বিশটা মিসড কল, ছিছি, এ কেমন হয়েছে। ‘সরিরে, রাস্তায় জ্যামে ছিলাম, ফোন ছিল সাইলেন্ট।’

‘ভাইয়া, আপনাকে আব্বা দেখতে চাইছিলেন এজন্য এত ফোন।’

ফরিদের সাথে সিএনজিতে উঠে ভেবে চললাম, আব্বা কেনইবা আমাকে দেখতে চান? এমন কি পেয়ারের সন্তান আমি তার? আম্মা চাইলেও চাইতে পারেন দেখা করতে। খেয়েছি কিনা, ঘুমিয়েছি কিনা, স্কুলে পরীক্ষায় ভাল করছি কিনা, ঠান্ডা লেগে গা’গরম হল কিনা এইসব কর্মে আমাকে যা বিরক্ত করে তোলা—আম্মাই তো করতেন, খুব বিরক্ত লাগতো, এত কিসের খাতের? আব্বার তো এরূপ বিষয় নেই, একদিন আমাকে শুধু বেদম পিটিয়েছিলেন, একটা প্রেমপত্র লিখবার সময় তার হাতে ধরা পড়েছিলাম, খুব মেরেছিলেন, বলেছিলেন এইসব করছিস আর কলেজে চার বছর পড়ছিস, ইন্টারে দু’বার ডাব্বা মারা ছাত্র আমাদের বংশে ছিলনা। ওদিন ধোলাই খেতে খেতেও দার্শনিকের মত আমার মনে হয়েছিল, সারা জীবন করলেন জেনারেল স্টোরের ব্যবসা, মালিক হলেন শ্যামলি-মিরপুর রুটের চারটা হিউম্যান হলারের, এই লোকের বংশে কেউ ইস্কুল কলেজ পড়েছে আগে তো শুনিনি, দাদা পাকিস্তান আমলে আদমজি পাটকলের ফোরম্যান ছিলেন এইটা জানতাম শুধু। সেই আব্বা এখন হার্ট ফাউন্ডেশনে, রিং টিং না কী যেন পরানো হবে। এখন চাইলেও আর আমাকে পিটাতে তিনি পারবেন না। খুব ফূর্তি হল ভেবে, আবার নিজেকে পশুও মনে হল। আব্বা-আম্মা সন্তান হিসেবে সব দায়িত্ব কি আমার জন্য পালন করেননি?

না না পশু কেন? নিজেকে এত সহজে পশু ভাবাও ঠিক না। প্রতি জুম্মায় মসজিদে আমি তো নামাজে যাই, ভিক্ষাটিক্ষা দেই, মাঝেমধ্যে এমনকি ভাবি, আখেরি জামানায় মানুষ কেমন বখে যাচ্ছে, মুখে আল্লা-খোদার নাম নেয় হৃদয়ে জপে নিজনিজ ইয়ে। আমি কি আর তেমন কেউ? মানুষের কথা আমি খুবই ভাবি, একটা উন্মুক্ত পৃথিবীর কথা ভাবি যেইখানে সকল মানুষের সমান অধিকার। এসমস্ত ভাবনার ফাঁক গলে সিএনজিটা চলে আসে হাসপাতালের সামনে। ফরিদ আগে নামে, মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমি দেই।

সিএনজিঅলা বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘দুইশ দ্যান কা? আর বিশ ঠা’ দেন, খুব জাম গেলনা রাস্তায়? এত ঘুইরা ঘুইরা আওন লাগলো।’

বিরক্ত হিংস্র গলা চড়িয়ে বললাম, ‘মাইর খাইছ মাইর? যা ভাড়া তাই নিবা। রাস্তায় জাম হবেনা? তোমার মামুর বাড়ির রাস্তা নাকি?’

আব্বাকে পাওয়া গেল বিছানায় একটা শাদা চাদর গলা পর্যন্ত টানা। আম্মা ছাড়া কেউ নেই কেবিনে। যে যার মত দেখে চলে গেছে আমার বুড়ো আম্মাটাকে একা ফেলে, এই বয়সে হাসপাতালে রাত জাগা যায়? ফরিদকে ডেকে গাল দিতে ইচ্ছে গেল, এক শালা ভাই-বোন আমার মানুষ হলনা।

‘এসেছিস মিজান? বোস। আম্মা ক্লান্ত স্বরে বলেন, তার চোখের নিচে কালি। আম্মার বয়স কত হবে? ষাট? পঁয়ষট্টি? বসতে বসতে আমি কাশলাম, ‘আব্বার বয়স কত বলেন তো আম্মা?’

‘হবে তিয়াত্তর-চুয়াত্তর?’

‘আপনি আব্বার চাইতে কয় বছরের ছোট?’

‘এইসব কথা থাক মিজান।’

আমি চুপ হয়ে গেলাম। আব্বা ঘুমিয়ে আছেন, কেন ঘুমিয়ে আছেন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলোনা। ফরিদ এক কোণায় দাঁড়িয়ে বললো, ‘রিং পরাতে হবে ভাইয়া।’

‘আচ্ছা।’

‘তুমি আজকে কি থাকবে? আমি আর আম্মা তিনদিন ধরে আছি। রাত জাগছি, দিনে ঘুম নাই।’

‘থাকবো। না থাকার কী আছে।

ওরা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম, মন্দ লাগেলোনা। হাসপাতালে রাত কাটানো, জীবনে এই বাকি ছিল। আব্বার বৃদ্ধ বুক শাদা চাদরের নিচে ওঠানামা করছে, দেখা যায়। কয়টার দিকে যেন তার ঘুম ভাঙবে, তখন কিছু খেতে চাইলে কী করতে হবে ফরিদ বলে গেল, স্মরণ হচ্ছেনা। ধুর! ভাবতে ভাবতেই কেমন চোখ লেগে এলো, চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছি, মগজে যেনবা চলছে রেলগাড়ি—ঝমঝমাঝমঝম।

এসি কেবিনে মশা কীভাবে ঢুকেছে ভেবে পেলাম না, ঝিমুনিটা কেটে গেল।

মোবাইল ফোনের ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখলাম, রাত দুইটা বাজে। বেরুবো নাকি বাইরে? একা একা আর কেউ নেই, শুধু আব্বা আর আমি এক রুমে, এমন কোন রাত কি গিয়েছে জীবনে? বেশ তো বেশ লাগে ভাবতে, এটা নতুন অভিজ্ঞতা—অবশ্য কী বা কাজে লাগবে? আমার মনের দার্শনিক অংশ তখন জানায়, ‘অভিজ্ঞতা কাজে লাগেনা, কাজের থেকেই অভিজ্ঞতা হয়।’ বাহ বেশ তো কি চমৎকার কথা।

কেবিনের দরজা খুলে বাইরে এলাম, টানা বারান্দা। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোই লাগছে। পাশের কেবিনে দরজার পাশে রাখা চেয়ারে বসে একজন মহিলা ঢুলছে, মৃদু আলোয় চেহারা ভাল মালুম হয়না। দূরে রাস্তা দেখা যাচ্ছে, গাড়ি চলাচল খুব কম। হঠাৎ একেকটা প্রাইভেটকার ছুটে যাচ্ছে কিংবা পুলিশের পেট্রোল জিপ কিংবা দৌড়ে চলেছে কোন উন্মাদ, হ্যাঁ এই দৃশ্য প্রায় দেখেছি রাতের রাস্তায়, উন্মাদ কোন লোক হাঁটছে—পরনে ছিন্ন কাপড় নাহয় ন্যাংটা, পিছন পিছন দৌড়চ্ছে কিছু কুকুর কিংবা একটা কুকুর। এই শালা পাগলদের নিয়ে আমার সংশয় আছে, কেন পাগল হয়? ওইদিন দেখলাম, সেজেগুজে এক তরুণী রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে, আধন্যাংটা এক পাগল গিয়ে জড়িয়ে ধরলো! ছাড়ার নাম নেই, মেয়েটা চিৎকার করে কেঁদে অস্থির, শেষে লোকজন মেরে ছাড়ালো।

আচ্ছা, চোখ জ্বলছে কেন?

টের পেলাম খুব জ্বলছে চোখ। এবার কি চশমা নিয়ে ফেলতে হবে? চোখে আজকাল বড় জ্বালাপোড়া হয়, মাথায় যন্ত্রণা। মুহূর্তে ধোঁয়ার গন্ধ ঘাপালো নাকে, কোত্থেকে আসছে কে জানে। শীতের রাতেও কেমন গরম লাগছে, চারতলার এ হাসপাতালি টানা বারান্দা কাঁপছে কেন এমন? বারান্দার ও মাথা কেমন আলো হয়ে আছে। কী আলো কী আলো, আগুন ধরে গেল? আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করলোনা, চোখের সামনে দেখতে পেলাম এগিয়ে আসছে বন্যার মত হলুদ তাপোচ্ছাস। আগুনই তো, মেঝে কাঁপছে চারদিক কাঁপছে চোখের দৃষ্টি কাঁপছে। এখন হবেটা কী?

আজকাল ভাল জ্বালা হয়েছে, হাসপাতাল-কারখানা-গার্মেন্টস-শপিং মল সব যায়গায় ধুপ করে আগুন লাগে, এদ্দিন পত্রিকায় নইলে টিভিতে দেখেছি, লোকের মুখে শুনেছি—আজ সাক্ষাত দৃষ্টিনন্দন?

মুহূর্তে আমার দুনিয়াটা বড় হয়ে উঠলো।


গল্পটি এর আগে মাসিক শব্দঘর ও একটি লিটলম্যাগে পূর্বপ্রকাশিত (২০১৭)

ব্যবহৃত ছবি – ক্যারেল মিবেক (১৯১০)

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন