সত্যজিৎকে কয়েক লাইন

সত্যজিতের শৈশব

সেই এক বর্ষার মৌসুম। দিবানিশি সব সময়েই জল ঝরছে। চারদিক দিনের বেলাতেও সন্ধ্যা হয়ে থাকে। কখনও বা নামে মুষলধারা। মেঘের তীব্র ডাকে হঠাৎ চমকে উঠতে হয়।

এক দুপুরে বারান্দায় বসে আছি। অদূরে রান্নাঘর। দরজা খোলা। দেখতে পাচ্ছি খুব ধোঁয়া উঠছে। আম্মা আছেন যন্ত্রণায়। ভিজে কাঠে রান্না। বাঁশের চোঙে ফুঁ দিয়ে চুলোয় আগুন ধরে রাখার চেষ্টায় মুখের রেখা এঁকেবেঁকে যাচ্ছে তার। নিষ্ঠুরের মত জিজ্ঞেস করলাম, ‘আরও দেরি হবে?’ মহাধৈর্যশীল নারীটি উত্তর করলেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছ বাবা, আর একটু অপেক্ষা করো।’

তখনও ফারহানার জন্ম হয়নি, আমার সহোদরা শুধু হান্না। যখন তখন কাঁদা তার অভ্যেস। কোন কারণে কিছু আগে চিৎকার করে কেঁদেছে। এরপর ঘুম। আব্বা বাসায় ফেরেননি এখনও। ভিতরের ঘরে গিয়ে চিনির বয়াম থেকে উঁচু এক চামচ মুখে চালান করে দিলাম। পেটে বেশ ভাল রকমের ক্ষুধা। যদিও গোপনে চিনি চালানের ব্যাপারটা ক্ষুধার চেয়ে মিষ্টিপ্রীতির সঙ্গে বেশি জড়িত।

বেশ, মুখে কিছু পড়লো। এখন কী করা যায়? কেমন শীত শীত করছে। মোটা কালো রঙের একটা বই হাতে করে বারান্দার খাটে এসে বসলাম আবার। বন্ধু ইমরানের থেকে ধার করে আনা বই। সে যেহেতু কাছেই থাকে, ধার প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে উঠেছে।

রহস্যময় গল্পটিতে ঢুকতে সময় লাগলোনা। পুরনো ধরণের বাড়ি। জং ধরা বর্গা আর ঘুণে ছাওয়া কড়িকাঠ। অভাবী গুটিকয় চরিত্র। এ সব কিছুই আমার এত চেনা কেন? বই থামিয়ে একেকবার আমাদের বড়ঘরের ছাদের কথা মনে পড়ছে। ঐ ঘরে দাদির বসবাস। বড় লোহার বর্গাগুলোকে আরও ছোটবেলায় আমরা বলতাম রেললাইনের অংশ। দেশভাগের আগে এই ভিটেয় বসবাস করতো হিন্দু মানুষজন। তাদের হাতে তৈরি চুনসুরকিতে গাঁথা পাকা ছাদের দালান। ছাদের ঐ কুচকুচে লোহার বর্গাগুলো রেল লাইনের অংশই হয়ে থাকবে – বড়রা মজার ছলে আমাদের এমনি বলত, কিংবা এটা ছিল তাদের নিজেদেরও বিশ্বাস।

অতঃপর আমি আবার গল্পটায় ডুবে গেলাম।

অভাবে না খেতে পেয়ে অসুখে ভুগে মূল চরিত্রটি মারা যাচ্ছে। নিজের সাময়িক ক্ষুধার সঙ্গে আমি ঐ না দেখা লোকটির কষ্টকে মিলিয়ে নিচ্ছি। আর বইয়ের পাতার বৃষ্টির সঙ্গে বাস্তবের বৃষ্টি, পুরনো আমলের ছায়া ছায়া ভঙ্গুর দালান, ছাদ ভেদ করে টুপ টুপ জল পড়ছে, আর কিরকম একটা ঘ্রাণ – পুরো ব্যাপারটা হয়ে উঠছে আমার চিরস্থায়ী স্মৃতির অংশ।

তখন আব্বা ফিরলেন। মাথা উঁচিয়ে একবার তাকে দেখলাম। বিড়বিড় করে কিছু বলছেন। চেঁচিয়েও উঠলেন, ‘ও রেজার মা, গামলাটা কোতায় রেখোচো, পানি পড়তেচে তো।’ আমি কিছুটা ঘোরগ্রস্ত হয়ে দেখলাম আমাদের ছাদ চুঁইয়েও পড়ছে জল। আব্বা একটা সিলভারের গামলা এনে রাখলেন সেই বরাবর।

লোকটি গল্পের শেষে মারা যায়। মরে ভুত হয় কিনা বলবোনা। এও বলবোনা কী তার নাম। কিন্তু এক কিশোর সেই গল্পের আবেশে নিজেকে এমন মিশিয়ে ফেললো যে বাকি জীবন আবেশটা আর কোনদিন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হবেনা।

এই কি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার প্রথম স্মৃতি?

পরিষ্কার স্মৃতি হিসেবে প্রথমে এ ঘটনাটিই মনে পড়ে। বাসায় ভিসিআর ক্যাসেট ভাড়া করে এনে গুপী-বাঘা দেখছে সবাই এমন কিছু দৃশ্য দেখতে পাই ভাসা ভাসা। ওসব যে সত্যজিতের ছবি, তা আমি জানি আরও অনেকদিন পরে।

কালো মোটা বইটিতে ফিরে যাই। ভুতের গল্পের বিশাল সংকলন। বর্ষার মৌসুম থেকে শীত, গোটা পঞ্চাশেক অন্য লেখকের ভিড়ে সত্যজিতেরই চারটা লেখা, সমস্তই পড়ে ফেললাম আমি।

সেই যে এক সম্পন্ন পরিবারের চাকরটির গল্প। বিজন গ্রাম্য পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। ড্রাইভার চলে গেল মেকানিক ডেকে আনতে। উত্তম পুরুষ গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন তার দিকে চেয়ে রয়েছে এক কাকতাড়ুয়া। অতঃপর শীর্ণ মুখটি এগিয়ে এলো। বড় চেনা ঠেকছে তাকে। দীর্ঘদিনের কাজের মানুষ ছিল সে, একদিন চরম অপবাদ দিয়ে লোকটিকে বাসা থেকে উত্তমপুরুষ নিজেই তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বড় হয়ে উঠবার পর যখন বুঝলাম যে মানুষ একা হলে নিজের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া তার উপায় থাকেনা, আর সেটা ভয়ানক, মনে হয়েছিল ভুতের গল্প কি শুধুই ভুতের গল্প থাকে সব সময়?

সত্যজিতের গোটা পরিবারের সঙ্গেই আমাদের বেড়ে ওঠা কেমন জড়িয়ে আছে। উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনি আর পান্তাবুড়ির কাহিনী তো শুনতাম মায়ের মুখেই, ঢাকায় নানাবাড়িতে যখন আসতাম প্রতি বছর ফাইনাল শেষে, আমার বিনোদনের উপায় ছিল সুকুমার সমগ্রের লাল রঙা প্রথম খন্ডটি। সবার হাতের ছোঁয়া পেতে পেতে কালচে হয়ে উঠেছিল পৃষ্ঠাগুলি। সেটা বড়রা পড়ছে, ছোটরা পড়ছে। কোন কোন বিকেলে গল্পের আসর বসতো। উঁচু স্বরে রসিয়ে রসিয়ে পড়া হত হ-য-ব-র-ল। হিজিবিজবিজকে অনুযোগ করা হচ্ছে তাদের বংশে সকলের নামই হিজিবিজবিজ কিনা। সে অবাক হয়ে বলছে, ‘সকলের একটা নাম মানে? আমার মামার নাম তকাই, মেসোর নাম তকাই শশুরের নাম তকাই।” আমরা হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছি।

নানাভাই বলতেন, “বুঝলিনা? এমন বাপ-বেটা ওরা সবাই, কী সব গল্প আর কবিতা লেখে, কী সিনেমা বানায়।”

সত্যজিতের গল্পের কথাই সব সময় ভাবি আমি। সাদামাটা বৈঠকী ঢং-এ আসর জমানো গল্প করার ক্ষমতা তার। তৃষ্ণার্ত পাঠক, শ্রোতা, ও দর্শকের যাবতীয় নিরাময় আছে লোকটির ঝোলায়। সঙ্গে আবিষ্কার করি তার সাহিত্য আর সিনেমার দর্শন কেমন বিপরীতমুখী।

অজস্র ভুতুড়ে গল্প, সায়েন্স ফিকশন আর জমজমাট রহস্য কাহিনীর জগতটি জাদুময়, পড়তে বসলে যা আমাদের অন্য এক ভুবনে নিয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই। আর সিনেমা? অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটি এমন বাস্তব, এমন দগদগে, আমরা অস্বস্তিকর মুগ্ধতা ও বিষণ্ণতা নিয়ে সেগুলোর দিকে চেয়ে থাকি।

এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আকাশ সারাদিন মেঘলা ছিল। রমজান মাস। মিরপুরের এই বাসা থেকে কল্পনা করি আম্মাকে। কাঠের চুলোর সংগ্রাম তাকে আর করতে হয়না, কিন্তু ধোঁয়া তো ওড়ে। রান্নাঘরে তিনি ইফতারের জোগাড় করছেন। দরজায় নিজের বালক বেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি আমি। দত্তদের বাগানে আজ বিকেলেই যে এক বিশাল জঙ্গলা ঝোপের মাঝখানে গোল ফাঁকা যায়গার সন্ধান পেয়েছে সে, ওখানে কি গোলাপী বাবুর স্পেসশিপ নেমেছে? তার মনে দ্বিধা।

আজ ত্রিশের দিকে চলেছে বয়স। আর সত্যজিৎ ছুটেছেন একশর দিকে। দুজনেই জানি, একে অন্যের কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমরা। হয়ত আমাদের আগের ও পরের আরও অনেক প্রজন্মের ক্ষেত্রে কথাটা সত্যি হবে।


[রচনাকাল – ২রা মে, ২০২০]

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন