একজন নারীলিপ্সু পুরুষ, যে পছন্দ করে কেবল উঠতি বয়সি তরুণীদের। প্রেম বলতে যে বোঝে শুধুই শরীর, এজন্য সে নিত্যই একটা বদলের চেইনে দিন পার করে। এক নারী থেকে আরেক নারীতে ভ্রমণটাকে তার মনে হয় প্রকৃত জীবন। মোটাদাগে এই হল সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা’র কাহিনী।
কিন্তু উপন্যাসের যে খেলাটা, এ কি মোটা দাগের? বিশ্বসাহিত্যের সার্থক উপন্যাসগুলো সব সময় গল্পের আড়ালে গল্প বলে, বক্তব্যের আড়ালে থাকে আবিষ্কার করতে পারা যাবে এমন অনেক বক্তব্য।
উপন্যাসটির মূল চরিত্র বাবরের মনোজগত নিয়ে ভাবতে শুরু করলে সমাজের জান্তব একটা দিকের বর্ণনা মিলে যায়, অনেকের মাঝে একের সুষমা যেন বাবর। তার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের প্রতি বিদ্রূপাত্মক, মধ্যবিত্তের পোশাকি ভদ্দরলোকির পানে সে সব সময় আঙুল দেগে রাখে, অনবরত নারীসঙ্গ বদল তার জীবনে কোনরকম অপরাধবোধ তৈরি করেনা। সে আত্মপ্রসংশা পছন্দ করে কিন্তু একইসঙ্গে কেউ আত্মপ্রচার করলে ওতে বিরক্ত হয়, কারও উপকার সে করলে অন্যপক্ষের বিনয়টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়।
নারীর ক্ষেত্রে বাবরের আকর্ষণ একেবারে চাঁছাছোলা শারিরীক হলেও নিজেকে সে মনে করে প্রেমিক। ভাড়া করা নারীতে তার আগ্রহ নেই, নারী তার কাছে শিকার করবার বস্তু।
পাশাপাশি অতীতের এক সুগভীর পাপের তাড়না বাবরের মজ্জাগত; বারংবার সে এই ট্রমা থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করে। কিংবা এ ট্রমাই হয়ত একজন পরাজিত মানুষ হিসেবে তার প্রকৃত চিহ্ন, উপন্যাসের শেষে যা তাকে একজন যোদ্ধায় পরিণত করতে চায়।
আঙ্গিক নির্মাণ ও শাখা প্রশাখা বিস্তারের চেয়ে উপন্যাসটির দীর্ঘ দেহ শুধু যেন মূল চরিত্র বাবরের প্রতিই বিশ্বস্ত ছিল। এ আখ্যানটির নারীগণ কি আমাদের পরিচিত? উঠতি বয়সী তরুণীদের ভাবালুতা এবং মনস্তাত্ত্বিক বাঁক বদলের দিকগুলো বড় সুস্থির মগ্নতায় ফুটে উঠেছে।
একই সঙ্গে ষাটের দশকের টিভিপাড়ার টুকরো ছবি কিংবা ঢাকা মহানগর। শুধুমাত্র একজন পুরুষের যৌন অভিজ্ঞতার গল্প নয়, এখানে যৌনতা স্রেফ একটা টুলস, বাবরের অভিজ্ঞতার গহনে যে বক্তব্য, মানব সমাজের প্রতি তা আমাদের এক ভিন্ন দৃষ্টি ফেলতে আহ্বান জানায়।
পাঠান্তে খেলারাম খেলে যা পাঠককে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিতে পারে, ভাবিয়ে তুলতে পারে, শেষ করবার পরেও মগজের পর্দায় দুলতে পারে বাবরের বিচিত্র জীবনের রেশ, এ বড় গহীন ক্ষমতা যে কোন বইয়ের পক্ষে। খেলারাম মাস্টারপিস।
রচনাকাল – জানুয়ারি, ২০১৭