মানুষের তিন ধরণের স্বভাবের কথা শ্রীরামকৃষ্ণের একটা গল্পে পাওয়া যায়৷ এই গল্পটি অনেক কারণে বিশেষ। তা পরে বলছি। গল্পটা এমন –
অনেক কাল আগের কথা। ধনী এক লোক বনপথে যাচ্ছিল। তখন তিন ডাকাত এসে তার পথ আটকায়। সাথে যা ছিল সব কেড়ে নেয়।
তিন ডাকাতের প্রথম জন শিকারকে দেখিয়ে বলে, “কাজ শেষ, একে বাঁচিয়ে লাভ নেই। যদি পুলিশে খবর দেয়। একে মেরে ফেলি আয়।”
তখন দ্বিতীয় ডাকাত বাধা দিয়ে বলে, “থাক রে, ওকে মেরে আর কী করবি। হাত-পা বেঁধে ফেলে দিয়ে যাই। তাহলেই হলো, পুলিশে খবর দিতে পারবে না।”
তারপর লোকটাকে ওরা বেধেছেদে রাস্তায় ফেলে চলে গেল। কিন্তু এর কিছু পরেই ফিরে এলো তৃতীয় ডাকাত। সে বলল, “খুব বিপদে ফেললাম তোমাকে ভাই। আসো তোমার বাধন খুলে দেই।”
লোকটাকে মুক্ত করে তৃতীয় ডাকাত তাকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিল। যেখান থেকে সে তার গ্রামে ফিরতে পারবে নিরাপদে।
“যাও ভাই, এবার তোমার আর বিপদ নেই।”
লোকটা বলল, “ডাকাত হয়েও এমন সহায়তা করলে আমাকে, এখন অতিথি হয়ে বাড়ি চলো। তোমার ভালো আপ্যায়ন হবে।”
ডাকাত রাজি হল না। বলল, “না রে ভাই। সে উপায় আমার কই। ওভাবে তোমার বাসায় গেলে পুলিশে ধরবে।”
লোকটাকে ভালমত রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে অতঃপর সে চলে গেলো নিজের গন্তব্যে।
এই গল্পটার শেষে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, প্রথম ডাকতটি তমোগুণ, যে বলেছিল “একে রেখে আর কী হবে, মেরে ফেলি।” দ্বিতীয় ডাকতটি রজোগুণ। এই স্বভাবের মানুষ ঘোর সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সংসারের নানান পাকেচক্রে জড়িয়ে জীবন কাটায়৷ রজোগুণে ঈশ্বরের যায়গা নেই। এ জিনিস মানুষকে ঈশ্বর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তবে তৃতীয় ডাকাতটি হল সত্ত্বগুণ। দয়া, ধর্ম, ভক্তি – এসব হয় সত্বগুণ থেকে। এটা হল সিঁড়ির শেষ ধাপ। এর পরেই ছাদ।”
গল্পটার শেষে অধিকাংশ পাঠকই মুগ্ধ হয়ে ভুলে যেতে পারেন যে এত ভালো ভালো গুণের উদাহরণ দিতে শ্রীরামকৃষ্ণের মত জ্ঞানী মানুষ কেন ব্যবহার করলেন ডাকাত বা ডাকাতির মত পেশাকে।
এটা স্বাভাবিক, কেননা গল্পের শিক্ষামূলক অংশে মানুষের তিনটি স্বভাব রিভিল হওয়ার পরেই পাঠক নিজের সাথে মিলিয়ে আনন্দ বা অনুতাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু আমার ধারণা, এই গল্পের আরও একটা বড় শিক্ষা হল, পৃথিবীতে এমনকি নিকৃষ্টতম পেশার যে মানুষ, তার মধ্যেও থাকতে পারে সত্ত্বগুণ, মানুষ ও জগতের প্রতি মমতা, মানুষ এমনই বিচিত্র এক প্রাণী।
লেখাটা শেষ করার আগে আমি নিজে আরও একটি গল্প জুড়ে দিতে চাই। লন্ডনে একবার এমন একজন পেশাদার খুনী ধরা পড়েছিল। সে টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করত। তবে তার উপার্জনের অধিকাংশ টাকাই সে দান করে দিত একটা মেটারনিটি ক্লিনিকে, যেখানে অজস্র নতুন শিশুর জন্ম হয় প্রতিদিন।