ক্ষয়ের গল্প অনেক রকমভাবে বলা যেতে পারে, বা তা অনেক রকমের হয়। উপন্যাসের জগতে ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষরণের প্যারালালে সমাজের বা রাষ্ট্রের ক্ষরণ দেখাতে পারাটা এক রকমের বিশেষ ঐতিহ্য অনেক কাল আগে থেকেই।
তবে আমাদের তো আধুনিকের পরের যুগ, আর আধুনিকোত্তর উপন্যাস মেলোড্রামা দূর – প্লট, এমনকি চরিত্রগুলোকেও তেমন স্কোপ দিতে চায় না। মাল্টিলেয়ার্ড হবার আকাংখ্যা তার থাকে, কিন্তু চরিত্র বা গল্প জমাট বাঁধার বিপক্ষে তার অবস্থান, সে শুধুই যেন বা সূর্য ডোবার সময় কিছু ঝোড়ো বাতাসের মাঝে আবিরের রঙ, বাতাসে ভেসে আসা ফিনাইলের ঘ্রাণ এবং অনেক দূর থেকে আসা হলাহলের মত, শোঁকা যায় শোনা যায়, খানিকটা দেখাও হয়ত যায় অথচ ছোঁয়া যায় না।
ইমতিয়ার শামীমের আমরা হেঁটেছি যারা গত শতাব্দীর একেবারে শেষ বছরগুলোয় লেখা। প্রকাশিত হয়েছিল এই শতাব্দীর শুরুতে। এবং এরও দুই দশক পর আমি যখন বইটা পড়লাম, লেখকের এক প্রজন্ম পরের মানুষ হিসেবে কিভাবে আমি একে বুঝে নেব?
আমার মাথায় ঝড় তোলে যে কোন লেখকের উপন্যাস রচনার উদ্দেশ্য, তার প্রকরণ, তার সফলতা-ব্যার্থতার রাফ খাতা।
আপনি যদি শুধু স্মৃতিচারণকে মূখ্য করে তুলতে চান, আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে বর্তমান থেকে আপনি অদৃশ্য, স্মৃতির মাঝেই বারবার বেঁচে উঠতে চাইছেন। কিন্তু স্মৃতি ব্যবহার করে উল্টো কাজও কী করা যায় না?
ধরেন, লিখলেন এমন স্মৃতির কথা, পাঠক চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না যে এই স্মৃতি তার পূর্বপুরুষেরও স্মৃতি যেহেতু সেও এই মহাপৃথিবীর মহাজনপদেরই উত্তরাধিকার, যে ক্ষয় ও ক্ষরণের মধ্যে দিয়ে চরিত্রগুলো এগিয়ে যায় পঠিত উপন্যাসের জগতে, তাদের সাহিত্যিক বাস্তবতা বিদ্রূপের স্বরে যেন বলতে থাকে – যাপন করা বাস্তবতার থেকে তার পার্থক্য বিশেষ নেই, অতীত তার চেহারা কিছুটা বদল করে বর্তমানেও রাজত্ব করছে।
উপন্যাসের ঘন শব্দের জালে আমরা হেঁটেছি যারা সেই সময়ের গল্প করে যখন স্বাধীন দেশের ক্ষমতার খেলা চলছে যেন দূর থেকে অন্য কারও চেলে রাখা দাবার ছক অনুসারে। এই খেলাকে সফল করে তুলছে উঁচু থেকে প্রান্তিক, সকল পর্যায়ের লোভী মানুষেরা, যারা এই দেশেরই সন্তান। কাক কাকের মাংস খায় না, কিন্তু মানুষ মানুষের মাংস খায় – এই কালো সত্য এই দেশের ইতিহাসে দগদগে এক ক্ষত হয়ে আছে, ইমতিয়ার শামীম কি সেই কথাই ধরে রাখতে চেয়েছেন? নিশ্চয়।
আর সেই ইতিহাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকেছে মামুনের মত চরিত্র। যারা সব কিছু তুচ্ছ করে মাটির বুকে শক্ত পায়ে দাঁড়ায় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে মাথা উঁচু করে। থাকে মনীষার মত প্রেমিকা, মারিয়ার মত স্নিগ্ধতা। পৃথিবীর অন্ধকার চক্র যাদের গিলে খায়।
হিউম্যান স্পিরিটের এক নড়বড়ে যায়গায় দাঁড়ানো উপন্যাসের কথক তথাগতকে আমি দেখি সে এতসব মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই কিনা, একজন নায়ক হয়ে উঠতে চেয়েছে, তাকে পলায়নপর আর আমরা বলে উঠতে পারি না।
আজকের বাংলাদেশ যে ইতিহাসের ফলাফল হয়ে ধুঁকে চলল, সেই ইতিহাসের ধারাভাষ্য আমরা হেঁটেছি যারা। এই উপন্যাস যেন বা তথাগতর মতই, নীরবে নিজের বক্তব্য ধরে রেখেছে। যে বক্তব্য এদেশের শাসকেরা প্রতি যুগে বালির নিচে চাপা দিতে চেয়েছে। পারেনি কি? মনীষার মত ভাগ্যবতী আমরা নই, আমাদের মুখে কেউ অধরা মায়ার জাল বুনে চলে না। তবে কথা থেকে যায়। যে কথা ভুলে যাওয়ার উপায় আমাদের নেই।
আবার ফিরে যাই উপন্যাসটির নির্মাণে। প্রথমত, এ বইকে আনপুটডাউনেবল মনে হয়েছে। একবার শুরু করলে তার জন্য শেষ না করে বসে থাকা কঠিন। এর নন-লিনেয়ার শরীরে শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত একটা আশংকা যাগে। বারবার মনে হতে থাকে তথাগত কি কোন আরোপিত লব্ধিতে পৌঁছাতে চায়, নাকি কাউকে দোষী করছে, আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাইছে বা দেখাতে চাইছে কোন আকস্মিক নাটকীয়তা?
নাটকীয়তা বা শক দুটিই এ বইয়ে আছে, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় অমনটি ছাড়া আর কীই বা হতে পারত? আর, শেষ পর্যন্ত তথাগত কিছুই চায় না পৃথিবী থেকে। তার লক্ষ্য এক খণ্ড নির্বাণ। সেখানে এ উপন্যাস এক আশ্চর্য স্বকীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে তার যাবতীয় সম্ভাবনা নিয়ে।