বই পড়লে টড়লে, ভাল সিনেমা সিরিজ দেখলে মানুষ একা হয়ে যায়, চিন্তা ম্যাচিউর হলে মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়, এইরকম একটা পোস্ট কিছুদিন আগে ভাইরাল হয়েছিল ফেসবুকে।
এই ধরণের পোস্ট তরুণদের মধ্যে ভাইরাল হবার দুইটা মানে থাকে।
এক, সবাই খুব বই পড়েন, তারকোভস্কি আর কুরোসাওয়ার কিংবা ডেভিড লিঞ্চের সিনেমা দেখেন। কিন্তু ভাবেন যে তার এই এস্থেটিক কাজকর্ম কেউ বুঝতে পারছেন না, কারও সাথে আলাপ করা যাচ্ছেনা, ফলে তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন।
দুই, ওনারা নিঃসঙ্গই। এই ধরনের পোস্ট থেকে নিজেদের প্যাট্রনাইজ করেন।
অর্থাৎ, তারা ভাবেন, “তাই তো। আমিও তো একা। কেউ আমারে বুঝতে পারছে না। বই নিয়ে তো আমার আগ্রহ আছে, ভাল ভাল সিনেমাও লিস্ট করে রেখেছি। বইমেলায়, আর অনলাইনে বিশেষ বিশেষ অকেশনে আমি প্রচুর বই কিনি, আমার একটা এস্থেটিক এনটিটি আছে।”
এনারা সেই ধারণাও পোষণ করেন যে, বুকিশ বা বইটই যারা পড়েন তারা তো একটু আলাদাই হন। আর সবার থেকে দূরে দূরে থাকেন।
সারাদিন গেম খেলছেন, মোবাইল হাতে ধরে আছেন, রেস্টুরেন্ট কালচারের প্যাটরন এমন এক তরুণ জেনারেশনের কাছে ঐ ধরণের লেখা উপরোক্ত কারণে ভালো লাগতে পারে। বই নিয়ে আগ্রহ আছে। বইয়ের সাথে ছবি তুলতে ভালবাসেন।
তবে ওনারা একাও হয়ে পড়েন তা সত্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রাত দিন চোখের সামনে একটা স্ক্রিণ ধরে ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকলে একা হবেন না তো আর কী হবেন।
এগুলো দোষ বা গুণ না, বা সেই পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখলে আসলে চলবে না মনে হয়।
একটা সামাজিক ডিজাইনের মাঝে এনারা পড়ে গিয়েছেন। এই ডিজাইনে পাঠের পরিমাণ কমে গেলেও ভিউয়িং এক্সপিরিয়েন্স কিন্তু আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি।
এনারা সবাই প্রচুর সিনেমা বা সিরিজ দেখেন। যেমন ধরেন, গেম অব থ্রোনস।
এত বড় এত অসাধারণ ড্রামা সিরিজ ফ্যামিলির কাউকে নিয়ে দেখা সম্ভব না। অর্থাৎ আর রেটেড ভাল ভাল কন্টেন্ট একা দেখে আর্ট নিয়ে কম্ফোর্ট জোনে থাকা যে তরুণ, তিনি পরিবারে সিনিয়রদের চেয়ে নিজেকে আলাদা মনে করতেই পারেন।
কারণ ফ্যামিলির বড়রা আর কী দেখেন? হয়ত কিছুই না। বা গসিপ টসিপ করেন। হিন্দি ও টার্কিশ সিরিয়াল দেখেন।
তরুণ সমাজের এই একাকীত্ব নিয়ে অনেক কিছু ভাবার আছে। তাদের সমাধান দরকার। ফাঁপা কোন কিছু দিয়ে যেন তারা নিজেদের একাকীত্বকে সাপোর্ট না দেয়।
অর্থাৎ বই পড়ে তারা নিজেদের যদি একা মনে করে, তবেই সেখানে একটা সলিডিটি আছে, নইলে বই বিষয়ক সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা ফাঁপা বলে ধরে নিতে হবে।
ধরেন, বই তো এস্থেটিক কিছু না। পবিত্র কিছু না। বইয়ের যা উপকার, তা আপনি ঐ সময়েই পেয়ে থাকেন যখন এস্থেটিকের শেলফ থেকে এটা একটা অর্ডিনারি দরকারি জিনিস হয়ে আপনার হাতে উঠে আসে।
বইয়ের কাজ যদি কিছু থাকে, তা হল মানুষ হিসেবে আপনার চিন্তারে সে নানান ভাবে ধারালো করতে পারে, আরও বেশি মানুষের কাছে আপনারে নিয়ে যেতে পারে।
বই পড়ে সত্যিই আপনি যদি কিছু শেখেন, সেইটা হল আরও বেশি মানুষের কাছাকাছি যাওয়া। বই আপনাকে একা করে দিলে বুঝতে হবে আপনার তা পড়া হয়ে উঠছে না আসলে।
শেষে একটা কথা বলি, তরুণ প্রজন্ম বড়দের রাজনীতিরও শিকার, যা বৈশ্বিক একটা ঘটনা।
আধুনিক জীবনে আমাদের সব উপকরণই তো খুব পার্সোনিফাইড। ধরেন, আগে একটা ফোনে চৌদ্দগোষ্ঠি কথা বলত।
এখন সবার একটা একটা ফোন। পরিবারের সবাই মিলে বসে শেষ কবে সিনেমা দেখেছেন মনে করতে পারেন?
শেয়ার্ড ইউনিভার্স আমাদের সিনেমায় যত বড়, রিয়েল লাইফে ততো সংকুচিত। তরুণ প্রজন্মরে তাই দোষ না দিয়ে তাদের রিয়েল লাইফকে এক্সপান্ড করে তোলা দরকার।