লস্কর মিয়ার জামাই

এনামুল রেজার গল্প লস্কর মিয়ার জামাই

লস্কর মিয়া তার লুঙ্গি কাছা মারল। যে কোন সময় হয়ত ছুট দেয়া লাগবে। বাঁদরটার মতিগতি খারাপ। শুরু থেকেই দাঁত খিঁচানি দিচ্ছে। তৈয়বের এই বাঁদর সন্ত্রাসীদের মত আচরণ করে।

আগেরবার সে যখন এসেছিল, বাঁদর তাকে ঘরেই ঢুকতে দেয়নি। দূর থেকে কয়েকবার ডেকে তৈয়বের সাড়া না পেয়ে ফিরে গিয়েছিল সে।

প্রথমে সে ভেবেছিল কপাল ভাল আজ। তৈয়ব তার ছাপড়ার সামনেই বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বাঁদরটাও নেই কোথাও। কাছে গিয়ে কয়েকবার ডাকতে বাজিকর তার লাল চোখ মেলে তাকাল।

কী চাও?

এট্টু আমার ঘরে যে আসা লাগে।

এন্নে পারবো না।

কেন পারবা না?

তৈয়ব মিয়া আর জবাব দিলনা। তখন কোত্থেকে বাঁদরটা এসে হাজির হল। টিনের চালে ধুপ করে শব্দ হতে সে উপরে তাকিয়ে দেখল হিসহিস শব্দ করছে জন্তুটা। ভয় পেয়ে সে আবার তৈয়বকে ডেকে তুললো।

এ ভাই, এত ঘুম কিসির এই দিন দুপুরি? ওঠো না।

লাল চোখ মেলে তৈয়ব আবার বললো, ‘কী চাচ্ছো?’

এট্টু আমাইগে বাড়িতি আসা যে লাগে।

এহনে পারবো না।

ধুর ভাই, এমন করতিছো কেন। মাইয়ে কি তুমারও ছেলোনা ঘরে?

কিছুটা রাগ দেখিয়ে লস্কর মিয়া উঠে দাঁড়াল। আর বাঁদরটা এমন ভঙ্গী করল যে মনে হল এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয় পেলেও সে আরও একবার শেষ চেষ্টা নেয়। বিপদ তো ছোট না।

অবশেষে টলতে টলতে খাড়া হল তৈয়ব। কোন কথা না বলে ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। বাজিকর তার সঙ্গে যাবেনা এমন ভেবে নিয়ে কাছাটা লস্কর মিয়া তখনই মেরেছিল। দৌড় দেবে এমন অবস্থার শেষ মুহূর্তে একটা ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে এলো বাজিকর।

বাজিকরকে কলোনির গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেই তার পিছে পিছে একদল ছেলেপেলে এমনকি উৎসুক বয়স্করাও ভিড়ে গেল। লস্কর মিয়া বিরক্ত হয়ে কয়েকবার বললো, ‘আরে কী চাইশ তুরা, যা যা। বান্দর দেহিশনি জীবনে?’

এমন বাঁদর অবশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়না। আকারে দশাসই। একটা হৃষ্টপুষ্ট দেশি কুকুরের সমান। তামাটে লোমের উপর কালো ডোরাকাটা। আসল ডোরা নাকি বাজিকর কালি দিয়ে এই ব্যবস্থা করেছে তা নিয়ে মানুষের কৌতুহল।

বাঁদরটি মনে হয় মানুষ দেখে নিজের গুরুত্ব দ্রুত বুঝে নেয়। দুপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে থাকে। সঙ্গে সমানে চলে দাঁত খিঁচিয়ে সবাইকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। বিনয় জিনিসটা এই বাঁদরের নেই।

লস্কর মিয়া আরও একবার পিছে পিছে আসা ভিড়টি কমানোর চেষ্টা নিল, ‘কী রে তুরা, মনে কচ্ছে বান্দর দেহিশনি শাউয়ো বাপের জম্মে?’

এই প্রশ্নে জমে ওঠা হৈচৈ কিছুটা বাধা পায়। কিন্তু তারপর যেই কে সেই। আবার সকলে তাদের পিছে পিছে আসতে থাকে। হেমন্তের নরম রোদের বিকেলটিতে লস্কর মিয়া কেন এক বাজিকর আর বাঁদর নিয়ে এলো কলোনিতে? কেউ ভেবে বের করতে পারেনা। শুধু দেখা যায় যে বিষয়টি নিয়ে তাদের আগ্রহ বেড়েই চলেছে।

এনামুল রেজার গল্প লস্কর মিয়ার জামাই

একতলা হলুদ দেয়ালের টিনশেড ঘর। সামনে ছোট মত একটা উঠোন। উঠোনের একপাশে নাইলনের নেটে ঘিরে বেগুনের চাষ করে লস্কর মিয়ার বউ শেফা বেগম। বাঁদর নিয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়ায় ওরা। বাজিকরকে একটা পিঁড়ে এনে দেয় লস্কর মিয়া নিজেই। কোমর সমান টিনের দেয়ালের ওধারে দাঁড়িয়ে কী ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করে কলোনিবাসী।

কিছুক্ষণ পর শেফা বেগমের পিছে পিছে সালোয়ার কামিজ পরিহিতা এক কিশোরী বের হয়ে আসে ঘর থেকে। মেয়েটির নাম নুজহাত। সবাই জানে। আত্মজাকে দেখে খুশি হয়ে ওঠে লস্কর মিয়া। আবার এই মেয়ে কেমন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ালো জীবনে তা ভেবে চাপা একটা যন্ত্রণা হয় বুকে।

এত লোকের সামনে ঘটনাটা ঘটবে, এতে ভয়ঙ্কর বিরক্তও লাগে তার। বাজিকরকে উদ্দেশ্য করে সে বলে, ‘এই আমার মাইয়ে, বুঝিছো তৈয়ব ভাই।’

তৈয়ব তার লাল চোখ মেলে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। গরীবের ঘরে রূপের কী কদর? এ প্রশ্নটিই তার মাথায় খেলে যায় সবার আগে। মেয়েটিকে সে বলে, ‘বসেন আম্মু, আমার সামনে গোল হইয়ে বসেন দেহি।’

কলোনির মানুষজন বাজিকরের সামনে কিশোরী নুজহাতকে আসনগুড়ি দিয়ে বসতে দেখল। দৃশ্যটা তারা বুঝেও যেন বুঝে উঠলনা ঠিকঠাক।

ডোরাকাটা ভীষণ বাঁদরটা ধীরেসুস্থে নুজহাতের কোলে চড়ে বসলো। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে দু’বার চেঁটে দিল মেয়েটির চিবুক। এরপর আবার সে চড়ে বসলো বাজিকরের কোলে। একই ভাবে মনিবের গলা জড়িয়ে তার দাড়িপূর্ণ চিবুকে ছোঁয়াল জিভ। দুইবার।

তখন কিছু আগের নরম রোদ শেষবারের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারদিকে। অদূরের লোকাল রেলস্টেশন থেকে ভেসে এলো হুইসেল। হয়ত নিদাঘের মেল ট্রেন এসে থেমেছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করবেনা।

পিঁড়ে থেকে উঠে দাঁড়াল তৈয়ব বাজিকর। কলোনিবাসী দেখলো যে লস্কর মিয়ার কানে কানে কিছু কথা সে বলছে। কী কথা, তা জানার জন্য উত্তেজনায় তলপেটে চাপ অনুভব করলো অনেকে। কিন্তু কারও কিছু জানা হলনা।

সপ্তাহখানেক পর অনেকেই শুনলো যে লস্কর মিয়ার কন্যা নুজহাতের বিয়ে হয়েছে নবোদয় নিবাসী জুতার ব্যবসায়ী আলিমুর রহমানের সঙ্গে। যদিও মেয়েটিকে ঐ বাঁদরকান্ডের পর তারা আর কেউই দেখেনি। বিয়েটা নাকি হয়েছে নুজহাতের মামার বাড়িতে।

বিষয়টিতে কলোনির লোকজন খুশি হয় তা না। তারা বলাবলি করে যে, সামান্য এক মালী হয়ে সে নিজেকে ভাবে কী? খুব বাড় বেড়েছে। কলোনিতে ধীরে ধীরে রটে যায় বাঁদরের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছে লস্কর মিয়া।

মানুষের কানাঘুষায় অস্থির হয়েই আরও এক বিকেলে তৈয়বের ছাপড়ার সামনে হাজির হল সে। দেখলো যে খুঁটিতে হেলান দিয়ে ছোটখাট একটি বাঁদর ঘুমাচ্ছে। বাজিকরের কোন চিহ্ন কোথাও নেই।

কয়েকবার নাম ধরে ডাকতে অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই লোকটা উদয় হল। লস্কর মিয়া ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, ‘এরোম কইরে তো আর চলতিছেনা, লোকে ভাল জ্বালা দেচ্ছে তৈয়ব ভাই।’

জ্বালা দিতি দেও। মাইয়ের তো বিয়ে দিয়ে ফেলাইছো। আর চিন্তা কিসির জন্যি?

লোকে কচ্ছে আমি নাকি বান্দরের সাতে মাইয়ের বিয়ে দিছি। এখ্যান নিদান তুমি দেও।

তৈয়ব বাজিকর কী বলবে ভেবে পায়না। হেমন্তের আকাশে তাকিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ডোরাকাটা বাঁদরটা আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। ধুপধাপ শব্দ করে নামবেনা টিনের চালে। মুহূর্তে বড় বিষণ্ণ লাগে তার।


[রচনাকাল – ৩রা জুন, ২০২০]

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন