আমরা কী বলি যখন ভালবাসা নিয়ে বলি ● রেমন্ড কারভার

আমরা কী বলি যখন ভালবাসা নিয়ে বলি

আমেরিকান লেখক রেমন্ড কারভারের খোঁজ আমি পেয়েছিলাম তার এক ভাবশিষ্যের কাছে। হারুকি মুরাকামি। আত্মজৈবনিক What I Talk About When I Talk About Running নামটা তিনি ধার করেছিলেন গুরুর What We Talk About When We Talk About Love থেকেই। কেমন নেশা ধরানো ব্যাপার আছে কারভারের লেখায়, বলতে অস্বস্তি লাগে চেনা জীবনের এমন অনেক গোপনীয়তা, সহজ সরল সংলাপে নির্মিত রূপক যাদের খালি চোখে ঠিক ধরাছোঁয়া যায়না। চমৎকার সব কবিতা লিখলেও লোকটি বিখ্যাত হয়ে আছেন তার শক্তিমত্ত বিষণ্ণ গল্পগুলোতেই। সমাগত গল্পটি আমি অনেক দিন ধরেই চেয়েছি অনুবাদ করতে। অবশেষে ইচ্ছা পূরণ হল। আগ্রহী পাঠক তার গল্প সংকলন Where I’m Calling From খুঁজে নিয়ে পড়তে পারেন। নামটা কত সুন্দর না?

এনামুল রেজা

আমার বন্ধু মেল ম্যাকগিনিস কথা বলছিল। সে পেশায় কার্ডিওলজিস্ট।

ওর কিচেন টেবিলে বসে জিন গিলছিলাম চারজনে। আমি আর মেল, মেলের দ্বিতীয় বউ টেরেসা – আমরা ডাকতাম টেরি, আর আমার বউ লরা। সিংকের ওপাশের বড় জানালা গলে আসছিল সূর্যের আলো।

ঐ সময়ে আলবুকার্কে থাকি আমরা। তবে একেকজন ছিলাম একেক অঞ্চলের মানুষ। 

টেবিলের উপর বাটি ভরা বরফ। সমানে কণ্ঠস্থ হচ্ছে জিন আর টনিক। কথার স্রোতে এক সময় খেয়াল করলাম আমাদের আলাপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভালবাসা।

মেল ভাবতো প্রকৃত ভালবাসা আত্মিক ভালবাসার চেয়ে কোন অংশে কম কিছু নয়। মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হবার আগের পাঁচ বছর ও কাটিয়েছিল ক্রিশ্চান সেমিনারিতে। আজও ঐ বছরগুলোকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় মনে হয় তার।

টেরি বললো, মেলের সঙ্গে বসবাসের আগে যে লোকটির সঙ্গে তার সংসার ছিল, সে টেরিকে এতই ভালবাসতো যে এমনকি তাকে খুন করতে চেষ্টা করেছিল।

“প্রতি রাতে মারধোর করতো লোকটা। হাঁটু ধরে বেডরুম থেকে হিড়হিড় করে ড্রয়িং রুমে এনে ফেলতো। টেনে-হিঁচড়ে আহত করত। এখানে ওখানে বাড়ি খেত আমার মাথা। বারবার বলতো, ‘ভালবাসি, তোকে ভালবাসি খানকি মাগী।’ এমন ভালবাসা নিয়ে কী করতে তোমরা বলো?’

রোগা পাতলা মিষ্টি চেহারার এক মেয়ে টেরি। গভীর চোখ। পিঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ধূসর চুল। টারকুইসের নেকলেস আর লম্বা ঝুমকা পরতে পছন্দ করত।

ওর প্রশ্নের জবাবে অবাক হল মেল, ‘বোকার মত কথা। তুমি নিজেও বোঝো, ভালবাসা বলেনা একে। আমি জানিনা আর কোন নামে ডাকা যায়, কিন্তু যাই হোক, একে ভালবাসা বলতে পারোনা তুমি।’ 

‘তোমার যা ইচ্ছে ডাকতে পারো, কিন্তু আমি জানি ওটা কী ছিল। হয়ত ভাবছ মাথাটা গেছে আমার। কিন্তু ওতে যা সত্যি তা বদলে যাবেনা। মানুষ নানান রকম হয়, মেল। এটা ঠিক ও মাঝেমধ্যে উন্মাদের মত আচরণ করতো, কিন্তু ভালবাসতো আমাকে। হয়ত ওর নিজের মত করে, কিন্তু বাসতো।’  

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেল। জিনের গ্লাসটা হাতে নিয়ে লরা আর আমার দিকে তাকাল।

‘ঐ লোক খুনের হুমকি দিয়েছিল আমাকে।’ গ্লাসটা এক ঢোকে খালি করে জিনের বোতলের দিকে সে হাত বাড়াল আবার। ‘টেরির অতি আবেগ। ও হচ্ছে এমনি-করে-আমায়-লাথি-যদি-মারো-বাসবো-ভাল-আরো স্কুলের ছাত্রী। টেরি, ঐভাবে আমার দিকে তাকিওনা পাখি।’

চেয়ার থেকে উঠে টেরির দিকে এগিয়ে গেল সে। মৃদু হেসে আলতো করে ওর চিবুক ছুঁয়ে আদর করে দিল।

‘যা বলার বলে নিয়ে এখন ঢং করা হচ্ছে।’

‘ঢংয়ের কী আছে? যা আমার ধারণা, সেইটাই তো বলবো আমি।’

‘আচ্ছা, যাই হোক, এই বিষয়টা নিয়ে আমরা কখন থেকে কথা বলা শুরু করলাম?’ মদের গ্লাসে মন দিল টেরি। ‘সারাক্ষণ ভালবাসা নিয়ে চিন্তা করবে মেল। ঠিক ধরেছি না বাবু?’

হাসি ফুটল মেয়েটার চেহারায়। আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হবে। কিন্তু মেল থামলোনা।

‘যাই বলো, এডের ঐ আচরণকে ভালবাসা বলতে পারবোনা। এই আমার বক্তব্য পাখি।’ লরা আর আমার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কী বলবে? তোমাদেরও কি এমন আচরণকে ভালবাসা মনে হয়?’

‘আমি আর কীভাবে বলবো বলো? ঐ লোক, কী নাম বললে, এড। ওর নামই তো শুনেছি শুধু। এ ছাড়া আর কিছুই তো ওর সম্পর্কে জানিনা। তবে মনে হয়, তুমি বলতে চাইছ যে ভালবাসা একটা শাশ্বত ব্যাপার?’

‘যেমন ভালবাসার কথা আমি বলছি তা হল… এমন ভালবাসার কথা বলতে চাইছি, যেখানে তুমি কাউকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবেনা।’

আমার বউ লরা যোগ করলো, ‘এড কে বা কী আসলে হয়েছিল, কিছুই তো জানিনা। তবে অন্য কারও অবস্থা বাইরে থেকে দেখে বিচার করা কঠিন।’

লরার হাতের উল্টো দিকটা স্পর্শ করলাম আমি। এত সুন্দর করে ছাঁটা নখগুলো। মুহূর্তের জন্য হাসল সে। নিজের হাতে উঠিয়ে নিলাম ওর হাত।

কারভারের গল্প

দুহাতে নিজের বাহু আঁকড়ে ধরে টেরি বললো, ‘আমি ছেড়ে আসার পর ইঁদুর মারা বিষ গিলেছিল এড। সবাই মিলে ওকে সান্তা ফের হাসপাতালে নিয়েছিল। ঐ এলাকাতেই থাকি তখন আমরা, মাইল দশেকের মধ্যেই ছিল হাসপাতালটা। ডাক্তাররা এডকে বাঁচিয়ে তুললো ঠিকই, কিন্তু মাড়ি নষ্ট গিয়েছিল কোন বিচিত্র কারণে। দাঁতের উপর মাড়ি না থাকার কারণে কী ভয়ানক যে ওকে দেখাত, ঈশ্বর!’

শিউরে উঠলো টেরি। মিনিট খানেক চুপ করে বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ড্রিংকের গ্লাসটা হাতে উঠিয়ে নিল আবার।

লরা বললো, ‘কী না করে লোকে!’

‘আর কিছুই করবেনা। মৃতদের কিছু করার ক্ষমতা থাকেনা।’ নিচু গলায় বিড়বিড় করলো মেল। লেবুর পিরিচটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। এক টুকরো লেবু ড্রিংকের উপর নিংড়ে নিলাম আমি।

মাথা নাড়তে নাড়তে টেরি বললো, ‘অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিল বুঝলে। নিজের মুখে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনেছিল। সেটাও ঠিক মত পারলোনা, গুলিয়ে ফেলেছিল। বেচারা এড।’

মেল যেন নিজেকেই প্রবোধ দিল, ‘বেচারা এড না কচু। বিপজ্জনক লোক একটা।’

পয়তাল্লিশের মত হবে মেলের বয়স তখন। লম্বা। ছিপছিপে গড়ন। মাথাভর্তি কোঁকড়া নরম চুল। নিয়মিত টেনিস খেলার ফলস্বরূপ হাতদুটো তামাটে হয়ে উঠেছিল। মাতাল না হলে মানে স্বাভাবিক অবস্থায় ওর চলাফেরা বা অভিব্যক্তি, সব কিছুর মধ্যেই থাকত একটা মাপা সতর্কতা।

‘তবু সে আমাকে ভালবাসতো, এটুকু বলতে দাও।’ অনুনয় ফুটলো টেরির কণ্ঠে, ‘হ্যাঁ, তুমি যেভাবে ভালবাসো, এড ওভাবে বাসতো তা বলছিনা। কিন্তু বাসতো। এইটা অন্তত আমার জন্য তুমি মেনে নিতে পারো, পারো না?’

আমি টেরিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গুলিয়ে ফেলেছিল মানে কী বললে তখন? বুঝিনি।’

ঝুঁকে পড়ে টেবিল থেকে নিজের গ্লাস তুলে নিল লরা। কুনুইয়ে ভর দিয়ে দু’হাতে গ্লাসটা ধরে পালাক্রমে মেল আর টেরির দিকে তাকালো। এমনকি আমাদের বন্ধুদের জীবনেও এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটতে পারে – এত চেনা সব লোকজনের জীবনে, এসব ভেবেই হয়ত ওর হাঁ হয়ে থাকা মুখটায় খেলা করছিল রাজ্যের বিস্ময়।

আমি আবার জানতে চাইলাম, ‘বললে না তো, আত্মহত্যার সময় এড গুলিয়ে ফেলেছিল মানে কী?’

মেল বললো, ‘শোনো তাহলে।’

“আমাদের হুমকি দিতে পয়েন্ট টুটু ক্যালিবারের একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরতো এড। বোঝো অবস্থা। ওর পক্ষে অসম্ভব ছিলনা কিছুই। পলাতক আসামীর মত বসবাস করতাম আমরা। বিপদ হলে যেন ঠেকাতে পারি এই চিন্তায় আমি নিজেও একটা বন্দুক কিনেছিলাম। গাড়ির গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে রাখতাম জিনিসটা। ভেবে দেখ। আমার মত লোক কিনল বন্দুক! যদি দেখতে ঐ সব দিন কীভাবে আমরা পার করছিলাম। হাসপাতাল থেকে প্রায় মাঝরাতেই ইমার্জেন্সি কল আসত। এপার্টমেন্টে টেরিকে একা রেখে বের হতে হত। তখনও বিয়ে হয়নাই আমাদের। আমার আগের বউ-বাচ্চারা থাকত আলাদা বাড়িতে। ঐ এপার্টমেন্টে শুধু টেরি আর আমি। বাইরে বের হবার পর কেমন যে লাগত। মনে হত অন্ধকার থেকে এড হয়ত ঝাঁপিয়ে পড়বে। বা গাড়ির ব্যাক সিট থেকে কথা বলে উঠবে। গুলি ছুঁড়বে যে কোন সময়। প্রায়ই চিকিৎসার নাম করে আমার নাম্বারে কল দিত সে। বলতো, ‘কুত্তার বাচ্চা, তোর দিন শেষ।’ এমন ছোট ছোট ঘটনা। বিশ্বাস করবেনা, সব সময় কিরকম চাপা আতঙ্কে পাগল হবার দশা হয়েছিল।”

টেরি বললো, ‘এখনও ওর জন্য খারাপ লাগে আমার।’

নিচু কণ্ঠে আমার বউ তখন যোগ করলো, ‘ব্যপারটাকে এতদিন পরেও দুঃস্বপ্নের মত শোনাচ্ছে। কিন্তু, ও নিজের মুখে গুলি করার পর ঠিক কী হয়েছিল?’

লরা নিজেও একজন লিগ্যাল সেক্রেটারি। ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পেশাগত কারণেই। বুঝিনি কখন কীভাবে সম্পর্কটা এত গভীর হয়ে উঠেছিল দিনের পর দিন। ওর বয়স পঁয়ত্রিশ, আমার চেয়ে বছর তিনেক কম। ভালবাসাটা কেমন আমাদের? একে অন্যকে পছন্দ করি আমরা, একে অন্যের সঙ্গ উপভোগ করি। সহজ ওর সঙ্গে জীবন যাপন।

রেমন্ড কারভার

ঠিক কী ঘটেছিল? জানতে চাইলো লরা।

মেল বললো, ‘ঘরে বসেই নিজের মুখে গুলি চালিয়েছিল এড। পাশের ফ্ল্যাট থেকে কেউ গুলির শব্দ পেয়ে ম্যানেজারকে জানায়। সবাই মিলে দরজা খুলে ঐ অবস্থা দেখে এমবুলেন্স ডাকে। ওকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, ঘটনাক্রমে তখন ডিউটিতে ছিলাম আমি। বেঁচে ছিল, কিন্তু চেতনাহীন।’

‘টানা তিনদিন জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলে ছিল এড। মাথাটা অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠেছিল। স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে ফুলে প্রায় দিগুণ হয়ে ওঠা – অমন দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি আমি, না আর কোনদিন দেখতে চাইব।’

‘খবরটা পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যেতে চেয়েছিল টেরি। চেয়েছিল ওর পাশে বসে থাকতে। কিন্তু তখন ভেবেছিলাম ঐ অবস্থায় এডকে দেখা ঠিক হবেনা ওর। আজও তাই মনে করি আমি। এ নিয়ে একটা ছোটখাট ঝগড়াও করেছিলাম আমরা।’

লরা জানতে চাইলো,’ঝগড়ায় জিতেছিলে কে?’

টেরি বললো, ‘মৃত্যুর সময় এডের পাশেই ছিলাম আমি। যদিও বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা ছিলনা আর। তবু। আমি ছাড়া কেই বা থাকতো।’

অস্থিরতা ফুটে উঠলো মেলের গলায়, ‘বিপজ্জনক লোক ছিল ও। তুমি যদি একে ভালবাসা বলতে চাও, বলো।’

‘ভালবাসাই ছিল। হয়ত বেশির ভাগ মানুষের চোখে তা মনে হবেনা। কিন্তু এমন ভালবাসার জন্য জীবন দিত পারত ও। এবং দিয়েও ছিল তাই।’

‘নিশ্চিতভাবেই এইটাকে কোনদিন ভালবাসা বলতে পারবনা আমি। মানে, কে বলবে কী জন্য আত্মহত্যা করেছিল এড? অসংখ্য আত্মহত্যা দেখেছি জীবনে, কিন্তু কেউ কোনদিন বলতে পারেনি যে কেন মানুষ নিজের হাতে নিজেকে শেষ করে।’

ঘাড়ের পেছনে দুহাত দিয়ে চেয়ারটা বাঁকিয়ে পা মেলে বসলো মেল, ‘এমন ভালবাসায় আমার কোন আগ্রহ নাই। তোমার কাছে হতে পারে এটা ভালবাসা।’

টেরি বললো, ‘ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম আমরা। এড এমনকি একটা উইলও তৈরি করেছিল, ওর এক ভাই ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়, প্রাক্তন সেনাসদস্য, তাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল যদি ওর কিছু হয়ে যায় তো কাকে খুঁজে বের করতে হবে।’

গ্লাস থেকে আরও এক ঢোক জিন গিললো ও।

“তবে মেল ঠিকই বলেছে। এক রকম পলাতক আসামীর মত জীবন কাটছিল ঐসময় আমাদের। আতঙ্কে অস্থির থাকতাম। মেল সত্যিই ভয় পেত, ‘ঠিক না সোনা?’ একবার তো আমি পুলিশকেও জানালাম ব্যাপারটা। পুলিশ আর কী করবে? এড যদি কোন ঘটনা না ঘটায়, তাদের নাকি কিছু করার উপায় নেই। কেমন হাস্যকর শোনায় কথাটা ভাব।”

বোতলের তলায় যেটুকু জিন অবশিষ্ট ছিল, নিজের গ্লাসে ঢাললো টেরি। চেয়ার থেকে উঠে কাপবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল মেল। নতুন আরেকটা বোতল বের করলো।

লরা বললো, ‘নিক আর আমি অবশ্য জানি ভালবাসা কেমন বস্তু। মানে আমাদের ক্ষেত্রে আরকি।’

হাঁটু দিয়ে আমার হাঁটুতে একটা খোঁচা মারল ও। হাসি খেলছে চোখেমুখে, ‘ওই, এখন তোমার কিছু বলার কথা, তাইনা?’

জবাবে লরার হাতটা তুলে নিয়ে চুমু খেলাম আমি। বেশ অনেকক্ষণ ধরে। ব্যাপারটা এমন হল যে মজা পেল সবাই।

বললাম, ‘আমরা ভাগ্যবান।’

টেরি ফোড়ন কাটলো, ‘হয়েছে, এইবার থামো। ঈশ্বরের দোহাই। এখনও তো হানিমুন ভাবটাই যায়নাই। কিছুদিন রোসো। কতদিন যেন আছ একসঙ্গে? বছরখানেক? নাকি তারচেয়ে একটু বেশি?’

বিব্রত একটা হাসি নিয়ে লরা বললো, ‘দেড় বছরের মত।’

‘মোটে। আর কিছুদিন যেতে তো দাও।’ নিজের গ্লাসটা হাতে ধরে লরার দিকে তাকাল টেরি, ‘আরে মজা করলাম।’

এর মাঝেই নতুন বোতলটা খুলে ফেলেছে মেল। কিছুক্ষণ সবার হাতে হাতে ঘুরলো সেটা।

ও বললো, ‘শোনো সবাই, চলো টোস্ট করি। সত্যিকার ভালবাসার সম্মানে একটা টোস্ট।’

একসঙ্গে উঁচু করে ধরে জিনের গ্লাসগুলো ছোঁয়ালাম আমরা।

সমস্বরে বললাম, ‘ভালবাসার সম্মানে।’

মেল এবং নিক

পেছনের উঠোন থেকে একটা কুকুর ডেকে উঠলো। বাইরে দাঁড়ানো অ্যাস্পেন গাছের পাতারা বাড়ি খেতে লাগল জানালায়। অফুরান স্বস্তিকর আলো নিয়ে বিকেলের সূর্যটা আয়োজন করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই তো থাকতে পারতাম আমরা, কোথাও কোন এক জাদুর দেশে। একে অন্যের দিকে হাসিমুখে গ্লাস উঁচু করে ধরলাম, যেন একদল শিশু নিষিদ্ধ কোন ব্যাপারে একমত হয়েছে।

নৈঃশব্দ ভাঙল মেল।

‘আমি তোমাদের বলবো খাঁটি ভালবাসা কী জিনিস। মানে একটা ভাল উদাহরণ আমি দিতে পারি। তারপর তোমরা এ ব্যাপারে যার যার সিদ্ধান্ত জানাতে পারো।’

নিজের গ্লাসটা আবার ভরলো সে। কয়েক টুকরো বরফ আর লেবু মেশাল। যার যার গ্লাসে চুমুক দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। লরা আর আমার হাঁটু টোকা খেল একসঙ্গে আবার। ওর উষ্ণ উরুর উপর একটা হাত রাখলাম আমি।

মেল বলে চলল।

‘ভালবাসা যে আসলে কী, আমাদের মধ্যে কেই বা তা জানে? মনে হয় আমরা সকলেই ব্যাপারটায় নবিশমাত্র। আমরা বলি যে একে অন্যকে ভালবাসি, এবং আসলেই বাসি, এতে কোন সন্দেহ নেই। তোমরা বুঝতেই পারছ কোন ধরণের ভালবাসার কথা বলতে চাইছি।’

‘শরীরী প্রেম, এমন এক অপ্রতিরোধ্য টান যার কারণে বিশেষ কারও কাছে আমরা ছুটে না গিয়ে পারিনা, আবার পাশাপাশি ঐ ব্যক্তি যেমনি হোক তার অস্তিত্বের প্রতি আমাদের একটা মমতা থাকে। দৈহিক আকর্ষণ বা অতি আবেগীয় প্রেম যাই বলেই ডাক, এর সঙ্গে ঐ বিশেষ ব্যক্তির জন্য খেলা করে আমাদের রোজকার অনুভূতি, নিত্য তার যত্ন করা, খেয়াল রাখা।’

‘আমার আগের স্ত্রীকে আসলেই ভালবাসতাম কিনা এটা বুঝে উঠতে এখনও খুব বেগ পেতে হয়। কিন্তু ওকে তো ভালোই বেসেছিলাম, জানি আমি। সে জন্যে এদিক থেকে আমার অবস্থা টেরির মতই ধরে নিতে পারো তোমরা। টেরি আর এডের মত।’

কিছু সময় যেন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল মেল। এরপর বলে চললো আবার।

‘এক সময় মনে হত আমার প্রথম বউ মারজোরিকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসতাম। অথচ আজ কেন এত ঘৃণা করি তাকে? এটার ব্যাখ্যা দিতে পারবে তোমরা? সেই ভালবাসাটা তাহলে কোথায় হারালো? কোথায় যে হারাল, এটাই জানতে চাই আমি। কেউ যদি আমাকে জানাতে পারতো। এরপর ধরো এডের কথা। আচ্ছা, ওর কথাতেই ফিরি আবার। টেরিকে সে এতই ভালবাসতো যে ওকে খুন করতে চেয়েছিল আর শেষ পর্যন্ত খুন করলো নিজেকেই।’

কথা বলা থামিয়ে জিনের গ্লাসে চুমুক দিল মেল। চুপচাপ পান করে গেল কিছুক্ষণ।

‘আঠারো মাস ধরে একসঙ্গে আছো তোমরা। একে অন্যকে ভালোবাসো খুব। একটা আলো খেলা করে পাশাপাশি যখন থাকো। দেখলেই তা বোঝা যায়। কিন্তু তোমাদের পরিচয় হবার আগে দুজনেই তো আলাদা আলাদা মানুষকে ভালবেসেছো। এর আগে যার যার মত সংসারও করেছো অন্য কারও সঙ্গে, ঠিক আমাদের মতই। এবং সম্ভবত তার আগেও কাউকে না কাউকে ভালবেসেছো তোমরা। টেরি আর আমার কথাই ধরো। একসঙ্গে আছি পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে, বিয়ে করেছি চার বছর। বাজে ব্যাপার হচ্ছে, বাজে ব্যাপারটা, কিংবা হয়ত এটা ভালোর জন্যই, ধরো, ঠিক কালকেই, ঈশ্বর না করুক, আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এমনটা বলার জন্য – ধরো, আমাদের দুজনের মধ্যে কারও কিছু একটা হয়ে গেল, মানে কেউ একজন মারা গেলাম, তখন কী হবে? যে বেঁচে থাকবে সে হয়ত কয়েকদিন ভয়ানক দুঃখ আর শোকে ভেঙে পড়বে। জীবনকে অর্থহীন মনে হবে। কিন্তু এক সময় তো কেউ না কেউ তার জীবনে আসবে, আবার সে কাউকে না কাউকে ভালবাসবে। এত কিছু, এই এতসব ভালবাসার কথা আমরা বলছি আজ, সবকিছুই হয়ে উঠবে শুধু স্মৃতি। আমি কি ভুল বললাম? যুক্তিহীন কিছু? যদি ভুল বলে থাকি চাইব যে তোমরা আমার ভুলটা ধরিয়ে দাও। জানতে চাই আমি। মানে, আমি জানিনা কিছুই, সবার আগে আমিই ব্যাপারটা স্বীকার করলাম।’

‘ঈশ্বরের দোহাই মেল’, চেয়ার থেকে উঠে ওর দিকে এগিয়ে গেল টেরি, দু’হাতে কব্জি চেপে ধরল তার, ‘শরীর খারাপ লাগছে সোনা? ড্রিংক কি বেশি নেয়া হয়ে গেল?’

‘পাখি, আমি শুধু বললাম কথাগুলো। ঠিক আছে? যা আমার ধারণা, তা বলতে মাতাল হবার তো দরকার নেই। মানে, আমরা তো কথাই বলছি, তাইনা?’ টেরির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সে।

‘আচ্ছা বাবা, আমি তো সমালোচনা করছিনা তোমার।’

নিজের গ্লাসটা আবার হাতে উঠিয়ে নিল টেরি।

মেল বিড়বিড় করে উঠলো, ‘আজ আমার ছুটি। তোমাদের মনে করিয়ে দেই। আজকে ছুটি আমার। কেউ ডাকবেনা এসে।’

লরা বললো, ‘তোমাকে আমরা ভালবাসি মেল।’

লরার দিকে এমন ভাবে সে তাকালো, যেন ঠিক চিনে উঠতে পারছেনা। যেন লরা আর কিছু আগের সেই মেয়েটি নেই। বললো, ‘তোমাকেও ভালবাসি লরা। আর নিক তোমাকেও। বুঝলে কিনা? তোমরা হলে আমাদের হরিহর।’

হোয়াট উই টক এবাউট হোয়েন উই টক এবাউট লাভ

মেল বলতে শুরু করলো আবার।

‘তোমাদের যা বলতে চাইছিলাম, মানে প্রমাণ করতে চাইছিলাম একটা ব্যাপার। দেখো, ঘটনাটা কয়েক মাস আগের, এখনও তার জের চলছে, আর যতবারই ভালবাসা নিয়ে আমরা কথা বলার সময় বলি যে আমরা জানি ভালবাসা কী, ততবারই ঘটনাটা আমাদের লজ্জায় ফেলে দেয়।’

টেরি বললো, ‘আচ্ছা, হয়েছে অনেক। মাতাল যদি না হও তো মাতালদের মত কথা বলো না আর।’

মেল হয়ত রেগে গেল। শীতল চোখে তাকাল টেরির দিকে।

‘জীবনে একবারের জন্য হলেও কী একটু চুপ করবে তুমি? দয়া করে অন্তত এক মিনিটের জন্য?’

‘যা বলছিলাম। সেই বয়স্ক দম্পতি সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছিল শহরের বাইরে। এক অল্প বয়স্ক ছোকরা নিজের গাড়িটা ওদের ক্যাম্পারের উপর তুলে দিয়েছিল। একেবারে দুমড়ে মুচড়ে একাকার সব। বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা ওদের আছে, এমন বলার সাহস ছিলনা কারও।’

টেরি আমাদের দিকে তাকাল একবার। দু’চোখে কেমন দুশ্চিন্তা অথবা ভয়। জিনের বোতলটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলে চললো মেল।

‘সে রাতে অন-কল ডিউটিতে ছিলাম। মে কিংবা জুন মাসের ঘটনা। টেরি আর আমি ডিনারের জন্য বসেছি। হাসপাতাল থেকে ফোন এলো তখন। এক চ্যাংড়া মদ্যপ অবস্থায় বাপের পিকআপ চালাচ্ছিল হাইওয়ে ধরে। উল্টো দিক থেকে নিজেদের ক্যাম্পার চালিয়ে আসছিল ঐ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।’

‘এমন ভয়ানক সংঘর্ষ যে একেবারে যায়গাতেই মরেছিল ছেলেটা। বুকের খাঁচা ভেঙে ঢুকে গিয়েছিল পিকআপের হ্যান্ডেল। কত আর বয়স হবে? আঠারো উনিশ বড়জোর। অথচ বুড়োবুড়ি দুজনেই ছিল মধ্যসত্তরে। যায়গায় না মরলেও যত রকমের ইনজুরি সম্ভব, সবই হয়েছিল। প্রায় সব হাড়ে ফ্র্যাকচার, শরীরের ভিতরে আঘাত আর রক্তক্ষরণ, সারা গায়ে এখানে ওখানে রক্ত জমাট বেঁধে দাগ বসে যাওয়া, মাথায় আঘাত – সব কিছু। এমন নাজুক অবস্থা, তার উপর বয়সটাও ছিল ওদের বিপক্ষে। বুড়িটার দশা বুড়োর চেয়েও খারাপ ছিল। দুই হাঁটুর কাপ গুঁড়িয়ে, প্লীহা ফেটে যা তা অবস্থা। দুর্ঘটনার সময় সিটবেল্ট বাঁধা ছিল দুজনেরই। শুধুমাত্র এ কারণেই হয়ত বেঁচে গিয়েছিল ওরা।’

‘শোনো বন্ধুরা, এইটা আসলে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একটা বিজ্ঞাপন। এখন তোমাদের সামনে বক্তব্য রাখছেন ডঃ মেলভিন আর. ম্যাকগিনিস।’ হাসতে হাসতে টেরি বললো, ‘মেল, মাঝেমধ্যে কী যে বাড়াবাড়ি করো না! তবু ভালবাসি তোমাকে বাবু।’

টেরিকে ফিরতি হাসি দিয়ে মেল জানালো, ‘আমিও তোমাকে।’

দুজনেই চেয়ার থেকে উঠে একে অন্যের ঘনিষ্ঠ হল ওরা। চুমু খেল পরস্পর।

‘টেরি অবশ্য ঠিকই বলেছে। সিট বেল্ট বাঁধার বিকল্প নেই। তবে ঐ দুজনের অবস্থা আসলেই ভয়ানক ছিল। আমি হাসপাতালে যখন পৌছলাম, ছেলেটা ততোক্ষণে মৃত, একপাশে একটা বিছানায় পড়ে আছে। বুড়োবুড়িকে এক নজর দেখেই ইমার্জেন্সি নার্সকে জানালাম দু’জন সার্জন, একজন নিউরোলজিস্ট আর অর্থোপেডিককে খবর দিতে।’

জিনের গ্লাসে চুমুক দিল মেল। ‘বিস্তারিত ঘটনায় যাবনা। যতটা পারি সংক্ষেপে বলছি।’

‘কয়েকজন চিকিৎসক আর নার্স মিলে রাতভর মরণের সঙ্গে যুদ্ধ করলাম যাকে বলে। আর ঐ বয়স্ক মানুষ দুজনের প্রাণশক্তিও অবিশ্বাস্য। সচরাচর অমনটা দেখা যায়না। বুড়িটার অবস্থা তেমন ভাল না হলেও ভোরের দিকে এটা অন্তত টের পেলাম যে ওদের বেঁচে ফেরার পঞ্চাশ ভাগ সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আইসিইউতে দেয়া হল সঙ্গে সঙ্গেই। রোজ একটু একটু করে অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ক’দিন পরেই সাধারণ কামরাতেও নিয়ে আসা গেল দু’জনকে।’

কথা থামাল মেল। বোতলটা হাতে নিয়ে বলল, ‘এই স্বস্তার জিনটা গিলে নেই আগে। তারপর ডিনারে যাওয়া যাবে। আমি আর টেরি নতুন একটা রেস্টুরেন্ট চিনি। খুব ভাল। ওইখানে যাব আমরা। তবে শোনো, আগে এই কমদামী ফালতু জিনিসটা শেষ করি সবাই মিলে।’

টেরি বললো, ‘যদিও আমরা এখনও যাইনি। তবে বাইরে থেকে দেখলে রেস্টুরেন্টটাকে ভালই মনে হয়, বুঝলে।’

‘খাবার পছন্দ আমার। আরেকবার জন্ম নেয়ার সুযোগ থাকলে রাঁধুনি হয়ে জন্মাতাম। টেরি জানে, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ তোমরা।’ আঙুল দিয়ে গ্লাসের বরফ নাড়াতে নাড়াতে হাসলো মেল।

‘টেরি জানে। তবু ধরো, যদি আমাকে আরেকবার নতুন করে জগতে আসার সুযোগ দেওয়া হয়, আমি এক মধ্যযুগীয় নাইট হতে চাইব। বর্মে মোড়া একটা দেহ সব দিক থেকেই নিরাপদ, ঠিক কিনা? বারুদ আর বন্দুক আবিষ্কারের আগে অন্তত এটাই সত্য ছিল।’

টেরি সুর করে বললো, ‘মেল আসলেই ঘোড়ায় চড়া নাইট হতে চাইত। হাতে ধরা থাকবে ল্যান্স।’

ফোড়ন কাটলো লরা, ‘হ্যাঁ, আর কোন সুন্দরী মেয়ের ওড়না সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে।’

‘কিংবা ধরো এক সুন্দরী মেয়েকে নিয়েই।’

‘লজ্জা লাগেনা বলতে?’

টেরি বললো, ‘ধরো, তুমি তো কারও আজ্ঞাবহ চাকরও হতে পারতে। ঐ আমলে চাকরদের অবস্থা খুব একটা সুবিধার ছিলনা।’

মেল হাসল।

‘চাকর-বাকরদের অবস্থা কোন কালেই সুবিধার ছিলনা। তবে কী মনে হয় জানো, নাইটরাও তো কারও না কারও হয়েই কাজ করত। অন্য আরেকজনের বাহন হিসেবে। কিন্তু নাইটদের আমার ভাল লাগে, কারণ ওরা বর্ম পরত। যা পরলে কেউ আর তোমাকে সহজে আঘাত করতে পারবেনা। ঐ আমলে না ছিল কোন গাড়ি, না ছিল তোমার ঘাড়ে এসে পড়বে এমন মদ্যপ চ্যাংড়া ছেলেপিলে।’

টেরি এবং লরা

টেরি বললো, ‘আজ্ঞাবহ।’

‘মানে?’

‘ওদেরকে বলা হত আজ্ঞাবহ। বাহন না। আজ্ঞাবহ।’

‘তো? আজ্ঞাবহ কী চাই অন্যের কাজের বাহক, অর্থ তো একই। শব্দে কী যায় আসে। যদিও, এর মানে দাঁড়ায় আমি মূর্খই। শুধু নিজের কাজটা পারি, এক হৃৎপিণ্ডের সার্জন, তবে আমায় মেকানিকও বলতে পারো তোমরা। রোগী দেখি, এইটা ঐটা নাড়িচাড়ি, তাদের যন্ত্রপাতি সারাই করি।’

‘থাক, আর ভদ্রতা দেখাতে হবেনা।’

আমিও চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, ‘মেল হচ্ছে এক বিনয়ী ঠোঁটকাঁটা টাইপের লোক। তবে যাই বলো, বর্মের ভিতরে কিন্তু নাইটরা শ্বাসকষ্টেও ভুগত। মানে দম বন্ধ হয়ে আসারই কথা দীর্ঘক্ষণ ওরকম লোহার জামা পরে বসে থাকলে। তাইনা? প্রচণ্ড গরমে লড়াই করতে গিয়ে অনেকেরই হার্ট এটাক হত। কোন একটা বইয়ে পড়েছিলাম, অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যেত নাইটরা। এমনকি ক্লান্তির তীব্রতায় উঠে বসাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো। কেউ কেউ যুদ্ধের ময়দানে মারা যেত নিজের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়েও।’

মেল বললো, ‘এইটা তো ভয়াবহ কথা বললে নিক। আসলেই। মানে অমন ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে থেকে অপেক্ষা করা যে, কখন কে এসে চাপা দিয়ে কাবাব বানিয়ে দেবে। ভয়ানক।’

‘হ্যাঁ, অন্য কারও আজ্ঞার বাহক এসে কাবাব বানাবে।’

‘ঠিক। অন্য আরেক আজ্ঞাবহ নাইট এসে একটা ধারালো বর্শা গেঁথে দেবে ধরাশায়ী নাইটের বুকে। ভালবাসার নামে। কিংবা অন্য যে কোন কারণে ঐ সব দিনে লোকে যুদ্ধ করতো।’

‘ঐ আরকি। আজকের দিনেও মানুষ একই কারণে যুদ্ধ করে।’

লরা বললো, ‘কিছুই আসলে বদলায় না।’

লরার গালদুটো তখনও লাল হয়ে ছিল। চোখ দুটো উজ্জ্বল। নিজের গ্লাসটা সে ঠোঁটে ছোঁয়াল।

গ্লাসে আবার জিন ঢাললো মেল। বোতলটা হাতে নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো আর কতক্ষণ চলবে। এরপর সেটা টেবিলে রেখে হাত বাড়ালো টনিকের জন্য।

লরা জানতে চাইলো, ‘সেই বৃদ্ধ দম্পতির কী হল? ওদের গল্পটা তো শেষ করলেনা।’

অনেকক্ষণ ধরেই একটা সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছিল ও। ম্যাচের কাঠি জ্বলছিলনা ঠিকঠাক।

ঘরের ভিতর ফিকে হয়ে আসছিল সূর্যের আলো। কিন্তু বাইরে থেকে অ্যাস্পেন গাছের পাতারা আগের মতই ছায়া ফেলছিল জানালার ফ্রেমে। খেয়াল করে দেখলাম যে সেই ছায়ার নকশা একটু আগে যেমন ছিল এখন আর তা নেই। বদলে গেছে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘বৃদ্ধ দম্পতির কী হল তারপর?’

টেরি বললো, ‘বৃদ্ধ কিন্তু বুদ্ধিমান।’

মেল ওর মুখের দিকে তাকাতে হাসলো টেরি, ‘মজা করলাম সোনা, গল্পটা বলো ওদের। কী হল তারপর যেন?’

‘মাঝেমধ্যেই এইরকম করো তুমি…’

‘দোহাই তোমার মেল। সব সময় এমন সিরিয়াস কেন হয়ে যাও? তোমার সঙ্গে কি একটু মজাও করা যাবেনা?’

টেরির দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে মেল প্রশ্ন করলো, ‘যা বলছি এর মধ্যে মজাটা কোথায়?’

এমন সময় ওদের কথার মাঝে ঢুকে পড়লো লরা, ‘আরে এরপর কী হল সেটাই তো বলছোনা।’

এবার লরার দিকে ফিরে তাকাল মেল।

‘যদি টেরি না থাকত আমার জীবনে, টেরিকে যদি না আমি এত ভালবাসতাম, আর নিকি যদি আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু না হত, তোমার প্রেমে পড়তাম আমি নির্ঘাৎ। ওর থেকে তোমাকে নিয়ে ভেগে যেতাম।’

টেরি নরম স্বরে বললো, ‘আচ্ছা, তোমার গল্পটা শেষ করো দেখি। এরপর ঐ নতুন রেস্তোরায় খেতে যাব আমরা, ঠিক আছে?’

‘বেশ। কোন পর্যন্ত যেন বলেছিলাম?’ টেবিলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো মেল।

‘রোজই বুড়োবুড়িকে দেখতে যেতাম। কখনও দিনে দুইবার করেও। পাশাপাশি বিছানায় শোয়ানো। ব্যান্ডেজ আর প্লাস্টারে মোড়া সারাদেহ। মানে ঐ সিনেমায় যেমন দেখি আমরা। শাদা ব্যান্ডেজে পুরোপুরি ঢাকা। একেবারে সিনেমার মমির মত। শুধু চোখ, নাক, আর মুখের যায়গায় ছোট ছোট গর্ত। তার উপর বুড়িটার এক পা উঁচু করে সিলিংয়ে বাঁধা। দুজনেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিল। তবে মানসিকভাবে যে ভেঙে পড়ছিল সে হল ঐ বুড়োটা। তার মুখের গর্তটার কাছে একদিন কান নিয়ে গেলাম। কোন মতে বুড়ো যা বললো তার অর্থ তোমরা অনুমান করতে পারো? বুড়োর মন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল কারণ ব্যান্ডেজের কারণে মাথা ঘুরিয়ে নিজের বউটাকে দেখতে পাচ্ছিলোনা সে।’

টেবিলের চারপাশে আমাদের দিকে একবার করে তাকালো মেল। এরপর মাথা নেড়ে বললো, ‘শালার বুড়ো হাড় এই দুঃখেই ধুঁকে মরছিল যে নিজের বুড়িটাকে দু’চোখে এক নজর দেখবে, সে উপায় তার ছিলনা।’

আমরা সবাই একসঙ্গে মেলের দিকে চেয়ে রইলাম। সে বললো, ‘মানে আমি কী বলতে চাইছি, বুঝেছ তোমরা?’

আমরা কী বলি যখন ভালবাসা নিয়ে বলি

হয়ত একটু নেশামত হল সবার। ঘরটা আঁধার হচ্ছে একটু একটু করে। জানালার ওপাশে ডুবতে থাকা সূর্যের আলো। কিন্তু উঠে যে একটু লাইট জ্বেলে দেব, সে ইচ্ছে কারও মাঝেই দেখা গেলনা।

মেল বললো, ‘জিনের বোতলটা তো খালি হয়নাই। চলো, এইটাকে আগে খালি করি। তারপর ঐ নতুন রেস্তোরায় খেতে যাব সবাই।’

‘ডিপ্রেসড হয়ে আছে ও।’

টেরি বললো, ‘মেল, একটা পিল নেবে ডিপ্রেশনের জন্য, দেব?’

‘যা যা নেওয়ার ছিল, সব নিয়েছি।’

বললাম, ‘ডিপ্রেশনের জন্য আমাদের সবারই মাঝেমধ্যে পিল নেওয়া দরকার।’

‘কারও কারও জন্ম থেকেই ওটা দরকার হয়।’ টেবিলে আঙুলের নিচে কিছু একটা ডলছিল টেরি, থেমে গেল।

‘আমার মনে হয় বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে আসলে। কারও কোন আপত্তি আছে আমি আমার ছেলেমেয়েদের যদি ফোন করি?’

‘মারজোরি ফোন ধরলে? বাচ্চাদের বদলে ও যদি ফোন ধরে তখন কী করবে? ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তোমার খারাপ লাগবে আরও বেশি।’

‘মারজোরির সঙ্গে কে চায় কথা বলতে? আমি শুধু আমার বাচ্চাদের সঙ্গেই কথা বলবো।’

‘ও আরেকটা বিয়ে করুক, বা মরেই যাক – এমন কোন দিন নেই যে এসব বলেনা মেল। এক বয়ফ্রেন্ড আছে মারজোরির। বাচ্চারা আছে সঙ্গে। মেলের পাঠানো টাকায় নিজের বয়ফ্রেন্ডকেও চালিয়ে নেয়। শুধু এ কারণেই আবার বিয়ে করছেনা মহিলা। আমাদের দেউলিয়া করে ছাড়ার ফন্দি আরকি।’

দাঁতে দাঁত পিষল মেল, ‘মৌমাছিতে এলার্জি আছে ওর। প্রার্থনা করি আবার যদি বিয়ে নাও বসে, এক ঝাঁক মৌমাছির কামড়ে যেন মরে যায়।’

লরা বললো, ‘নির্লজ্জের মত কথা বলছ এবার।’

মুখ দিয়ে ভোঁভোঁ শব্দ করে দুটো আঙুলকে মৌমাছির ভঙ্গিতে টেরির গলা পর্যন্ত নিয়ে গেল মেল। তারপর নামিয়ে নিল হাত।

‘বিষাক্ত মহিলা একটা। মাঝেমধ্যে আমার ইচ্ছা করে মৌমাছিঅলা সাজি। ঐ যে হলুদ হেলমেট পরা। চোখমুখ কাঁচ দিয়ে ঢাকা। হাতে হলদে গ্লাভস আর গায়ে ফোম দেয়া কোট? তারপর এক বাক্স মৌমাছি নিয়ে মারজোরির দরজায় টোকা দেব। ও দরজা খুলতেই ঘরের ভিতর শুধু পোকাগুলো ছেড়ে দেওয়া। খেল খতম। অবশ্য এর আগে দেখে নিতে হবে যে বাচ্চারা ঐ সময় যেন বাইরে থাকে।’

পায়ের উপর পা তুলে বসলো মেল। কাজটা করতে অনেক সময় লাগলো তার। এরপর আবার পা নামিয়ে মেঝেতে রাখলো। টেবিলের উপর কুনুইয়ে ভর দিয়ে ঝুঁকলো সামনের দিকে। দু’হাতের তালুতে রাখলো মুখ।

‘হয়ত বাচ্চাদের ফোন দিতেও তেমন ইচ্ছা করছেনা আমার। হয়ত বাইরে গিয়ে এখন খাওয়া দাওয়াটা সেরে নিলেই ভাল লাগবে। কী বল সবাই?’

বললাম, ‘তাই করি চল। খাই আর না খাই, কিংবা মদ গিলি, এই মুহূর্তে বাইরে গিয়ে সূর্যাস্তের নিচে দাঁড়াব আমি।’

লরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বললে বুঝলাম না তো।’

‘যা বললাম তাই তো বললাম। মানে আমি এখন বাইরে যেতে চাইছি।’

‘কিন্তু আমার তো কিছু খাওয়া দরকার। মানে এমন খিদে কখনওই লাগেনা। ঘরে কিছু আছে টেরি?’

‘আছে। দেখি নিয়ে আসছি। পনির আর বিস্কুট থাকার কথা।’

এটুকু বলে টেরি বসেই রইল চেয়ারে। উঠে গেলনা কিছু নিয়ে আসার জন্য।

জিনভর্তি গ্লাসটা টেবিলে উপুড় করে দিয়ে মেল বললো, ‘জিন শেষ।’

টেরি জানতে চাইলো, ‘তো কী হবে এখন?’

আমি শুনতে পাচ্ছিলাম আমার হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করছে। সবার হৃৎপিন্ডই। বসে বসে শুনতে পাচ্ছিলাম মানুষের শরীরে তৈরি সেই চিরচেনা শব্দ, অথচ এক বিন্দু নড়ছিলাম না কেউ ঘরটা অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার পরেও।


অলংকরণ স্কেচ: রবার্ট মেইস বেন্ট

[অনুবাদের সময়কাল – জুলাই ২০২০]

মন্তব্য জানাতে আপনার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট অথবা ইমেইল ব্যবহার করুন