জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশ আছে তলানীতে। প্রাজ্ঞ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক্ষেত্রে যে কথাটা বলেছেন, তা কন্ট্রাডিকটরি মনে হতে পারে। কথাটা এই, “জ্ঞানের যে অনুশীলন তার মূল্য পৃথিবীজুড়েই কমে গেছে। এখন আসছে তথ্যের যুগ। তথ্য আর জ্ঞানতো এক না। তথ্যের অবাধ প্র্রবাহ জ্ঞানের চর্চাকে খর্ব করছে পৃথিবী জুড়েই। জ্ঞান এখন পুরো পৃথিবীতে পণ্যে পরিণত হয়েছে, কেনা যায়। নিজের অনুশীলন বা গবেষণা দরকার হয় না। এটা কেনা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ।”
জ্ঞান আর তথ্য এক না, এটা উনি বলতে পেরেছেন, কিন্তু গন্ডগোলটা কোথায় লেগেছে? উনি বলছেন যে জ্ঞান কিনতে পাওয়া যায়। তা ভুল এনালিসিস মনে হয়। কিনতে পাওয়া যায় তথ্য। অর্থাৎ, স্পেসশিপ নির্মাণের পদ্ধতি বা তথ্য কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু এটা জ্ঞান না। একটা দেশে স্পেসশিপ কেন বানানো দরকার ও আগামী দিনগুলোয় তার কাজ কী, এইটার রূপরেখা তৈরি করতে পারাটা জ্ঞান হতে পারে। কিংবা অষুধ প্রস্তুত করাটা ডাক্তারি না, রোগ এনালিসিসও মেশিন দিয়ে করা যায়, কিন্তু কোন সিচুয়েশন অনুযায়ী রোগীকে যথাযথ ডিল করতে পারার দক্ষতাকে জ্ঞান বলা যেতে পারে। এই দক্ষতা কিনতে পাওয়া যায়না। অর্জন করতে হয়।
অধিকাংশ মানুষ দেখবেন তথ্য আর জ্ঞানকে এক মনে করে।
এর রিফ্লেকশন পপুলার বই, সিনেমা বা বিজ্ঞাপনে দেখা যায়।
ওদিন এক সিনেমায় দেখলাম, নায়িকার বড় ভাই নায়ককে জিজ্ঞেস করছে, ‘বলো দেখি ছোঁড়া, হুতোম প্যাঁচা কটা ব্রাক্ষণের টিকি কেটেছিল?’
আত্মবিশ্বাসী নায়ক মৃদু কণ্ঠে জানাল, ‘আজ্ঞে, ৫১টি।’
‘শাবাশ। বিস্তারিত বলো, খুলে বলো।’
‘জ্বি। মহাভারত অনুবাদের সময় তিনি তো অনেক ব্রাক্ষণ নিয়োগ দিয়েছিলেন। তো যেসব ব্রাক্ষণ ছিলেন বদমায়েশ, লম্পট, তাদের টিকি আমাদের হুতোম মানে কালীপ্রসন্ন বাবু কেটে রাখতেন ট্রফি হিসেবে।’
নায়িকার ভাই উত্তেজিত হয়ে গেল জ্ঞানের এই বহর দেখে। বললো, ‘একসেলেন্ট!’
এই তথ্য থেকেই যদিও জ্ঞানের আলাপ দেখানো যেত। অর্থাৎ বোঝাপড়া। নায়িকার ভাই আর নায়ক যদি আলাপটা এভাবে এগিয়ে নিত।
‘এই টিকি কেটে নেয়াটা কি ঠিক মনে করো?’
‘এনার্কি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের টুলস হিসেবে ঠিক। কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই।’
‘কী রকম?’
‘আজ্ঞে, ধরুন, কালীবাবু জমিন্দার আছেন। তার আছে ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি টিকি কাটছেন।’
‘তো?’
‘দুশ্চরিত্র লম্পট বামুনের টিকির ভয় কী? টিকি তো তার আবার গজাবে। তার অপরাধ প্রবণতা কমবেনা।’
‘মানে?’
‘যেই কাজ আম জনতা পারেনা, অর্থাৎ বামুনের টিকি কাটা আম জনগণের পক্ষে অসম্ভব, ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তা করার মধ্যে কোন স্থায়ী সমাধান নেই।’
‘বলো কী? হুতোম কী করলে ভাল করতেন?’
‘আজ্ঞে, উনি অসৎ বামুনদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালাতে পারতেন।’
‘কী রকম?’
‘ধরেন, পত্রিকায় নিয়মিত ওসব বামুনের কাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করানো। তাদের অপকর্ম নিয়ে নাটিকা মঞ্চস্থ করা। পুস্তক লিখে কলিকাতার ধনী সমাজ ও শিক্ষিত সমাজের হাতে হাতে পৌছে দেওয়া।’
মানে ৫১ টিকির তথ্য থেকে এটা একটা সম্ভাবনার আলাপ। যা বর্তমানেও কাজে লাগতে পারে।
জ্ঞানের জার্নির একটা দিক হল নিশ্চয়তার ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সম্ভাবনার আলাপ করা।
কিন্তু তথ্যই জ্ঞান, এই জনপ্রিয় ধারণা যা করে, আপনাকে তথ্যভুক বানায়।
আপনি অনবরত তথ্য গিলতে থাকেন। আছেন গুগল মহাশয় ও বিবিধ মিডিয়া। এরা পর্যাপ্ত তথ্য সাপ্লাইয়ের মাধ্যমে আপনাকে ব্যস্ত রাখেন।
আপনার চেয়ে বুদ্ধিমান লোকেরা এই তথ্য’র কাঁঠাল আপনার মাথায় ভেঙে খেতে থাকে।
যেটা কম সম্ভব হত যদি না আপনি চিন্তা করতে রাজি থাকতেন তথা তথ্য ও জ্ঞানের ফারাক বুঝতেন।
জুন ৩, ২০২০
মিরপুর, ঢাকা